পরিচালক বাক্
Wednesday, September 28, 2016
‘বাক্’-এর
১০০তম পোস্ট হয়ে গেল। ১০০ শুধুই একটি সংখ্যা, সে কোনো বয়স নয় যে একটি পত্রিকার
বার্দ্ধক্য সূচীত করবে। পুনরাধুনিকের পথে ১০০টি পদক্ষেপ হয়ে গেল। ‘বাক্’ যেদিন তার
যাত্রা শুরু করেছিল, কেউ বিশ্বাস করেননি একটা ব্লগ একটা পত্রিকা হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জালে সাহিত্যচর্চা তখন খিল্লির ব্যাপার ছিল। আজ অনেক ব্লগজিন। এমনকি তাদের
কেউ কেউ ‘বাক্’-কে তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে কাঁটা মনে করেন। রাইভ্যাল ভেবে এড়িয়ে
চলেন। কিন্তু শুরুর সংগ্রামটা তাঁদের করতে হয়নি, শুরুর অপমানগুলো তাঁদের সইতে
হয়নি। সেগুলো কাঁটা নয়, চলার পথের ফুল ছিল।
অনেকেই প্রশ্ন করেন কেন পুনরাধুনিকের সঙ্গে ‘বাক্’-এর নাম আসছে? তাঁদের
উত্তর আমি আরেকটা প্রশ্ন দিয়েই দিই- আপনি নিজের জীবনের সঙ্গে কবিতার মতো একটা
অবান্তর ব্যাপারকে কেন যুক্ত করছেন? বাঙালির জীবনে কবিতার তো কোনো গুরুত্বই আজ
নেই, মাঝেমধ্যে পোস্ট করে ফেসবুকে দু-মিনিটে পাঁচটা লাইক পাওয়া ছাড়া, আর অন্যদের
কোবিতায় ‘অসাধারণ’ বা ‘ভাল লাগল না রে’ বলা ছাড়া। বাঙালির পলিটিকাল বোধ নিয়ে কথা
বলাটা শিঙিমাছের সামুদ্রিক বোধ নিয়ে কথা বলার মতোই অবান্তর। হ্যাঁ, বাঙালির জীবনে
অসীম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ফুটবল। ফুটবল হল সেই জিনিস যাতে লাথি বাঙালি মাঠে
নয়, বাংলা খবরের কাগজের পেছনের পাতায় মারে। কিন্তু নিজে লাথ খেয়ে খেয়ে বিশ্বফুটবলে
এখন কত নম্বরে যেন? ওহো, সেটা তো আবার ভারতের র্যাংকিং! প্রাদেশিকতা করে ফেললাম।
ঈশ!
আলো অনেক সময় হিংস্র হয়ে ওঠে, নিষ্ঠুর হয়ে
ওঠে। কিন্তু সে তার হিংসাকে কখনও গোপনে প্রকাশ করতে চায় না। সরাসরি প্রকাশ করতে
চায়। যখন পারে না, তখন সন্ধ্যা শুরু হয়। তখন কবিতা শুরু হয়। রাত ঘনায়। তোমরা
দ্যাখো জ্যোৎস্না ফুটেছে। পৃথিবীতে কোথাও কোনো বিশুদ্ধ জ্যোৎস্না নেই। চাঁদ শুধু
তার অসহ্য সূর্যালোককে পৃথিবীতে নির্বাসন দ্যায়। আমিও ঠিক সেভাবেই ‘বাক্’-এর
একেকটি সংখ্যাকে প্রকাশ করতে চেয়েছি, পূর্ণ না হোক, আংশিক জোছনা।
কী করুণ লাগে, যখন দেখি একটি পত্রিকা তার
নতুন সংখ্যা প্রকাশের পরে বলছে, ‘স্থানাভাবে এবার সবার লেখা দেওয়া গেল না। মনোনীত
লেখাও বাদ পড়েছে। আগামী সংখ্যায় দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’ যেন মোচ্ছববাড়ির গেটে
দাঁড়িয়ে কর্মকর্তা জানালেন ভিখিরিরা এবার ফিরে যেতে পারে, কোনো খাদ্য তাদের জন্য
বাড়তি হচ্ছে না, আমন্ত্রিত আর নির্বাচিতদের মধ্যেই সব ফুরিয়ে গেছে। একটা ব্যাপারই
তখন স্পষ্ট হয়, কবিতা ছাপার ব্যাপারে পত্রিকাটির নয়, ওই কোবিদেরই গরজ ও তাগিদ
বেশি। তারাই ভিখিরি। যশের কাঙাল। এবং তাদের দুঃখ কমানোর জন্যই কথাগুলো বলা হচ্ছে।
লেখা যে ছাপা হল না, এতে কিছু কোবি সত্যিই মন খারাপ করে বসে থাকবে। হয়ত রাতের
মাংসভাত আজ আর মুখে রুচবে না। হয়ত বিছানায় আজ সুখ শান্তি থাকবে না। আর এই সংখ্যায়
যারা লিখল, তারা হয়ে গেল কিছুদিনের জন্য ‘পাত্তা পাওয়া’ বা ‘কল্কে পাওয়া’ কবি।
তারা এখন যাদের লেখা ছাপা হল না, তাদের মুখে ধোঁয়া ফুঁকে ফুঁকে ঘুরে বেড়াবে।
সত্যি, কবিতার মতো একটা স্বর্গীয় জিনিসকেও এমন আবর্জনার স্তরে নামিয়ে আনতে শুধু
বাঙালিই পারে। কোবি আর কাক এক হয়ে আছে এই বাংলায়। ‘বড়’ কোবিদের চিবিয়ে ফ্যালা হাড় এবং ছিবড়ে ‘বড়’
কাগজের ডাস্টবিন থেকে চেটে-চুষে না নিতে পারলে তাদের মনে হয় না নিজেদের কোবিজন্ম
সার্থক হল। ‘বাক্’ সেরকম বড় কাগজ কোনোদিন হতে চায়নি, তার যাত্রা পুনরাধুনিকের পথে।
প্রশ্ন হল
আপনি বিনাপয়সায় পাঠককে আপনার সাহিত্য দেবেন কিনা। সেটা পাঠকের উপরে নির্ভর করে।
আমি আমাদের ভারত-বাংলাদেশ দুটো দেশকেই বাংলা সাহিত্যের সাপেক্ষে অনগ্রসর ও দরিদ্র
মনে করি। এ-দেশে সাধারণ মানুষের কাছে যদি নিজের লেখা পৌঁছে দেওয়ার কোনো সুযোগ
পাওয়া যায়, সেটার জন্য আমি টাকা প্রত্যাশা করি না, এমনকি টাকা খরচ করতেও তৈরি
থাকি। আমি মনে করি এই দুটো দেশের জনসাধারণ সাহিত্যের দিক থেকে এখনও নিরক্ষরের
পর্যায়ে রয়ে গেছেন, এমনকি স্কুল-কলেজ থেকে পাস করার পরও। নব্বই শতাংশ বাংলা
সাহিত্যের এম এ পাস ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা আজ পঞ্চাশের দশকের পর থেকে বাংলা সাহিত্যে
কী হয়েছে কিছুই বলতে পারবেন না। সেটা ঘটিয়েছে আনন্দবজার এবং অন্যান্য
সাহিত্যমাফিয়ারা। আমি মনে করি এই দুটো দেশে ব্লগ এবং ফেসবুকের মাধ্যমে সাধারণ
মানুষের কাছে সাহিত্যকে পৌঁছে দিতে হবে। সেটা যদি তাঁরা গ্রহণ করতে না পারেন ঠিক
আছে, কিন্তু তাঁদের কাছে যেতে হবে। এটাই এখন আন্তর্জাল সাহিত্যচর্চার একমাত্র মিশন। এখানে কোনো
এলিট ও নাকউঁচু মনোভাবের সুযোগ নেই, কারন নেই। আমি মনে করি এই দুটো দেশে দাতব্য সাহিত্যসেবা এখন দাতব্য
চিকিৎসালয়ের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এবং পবিত্র কাজ। কিন্তু যখন কোনো লেখককে আপনি
নিজের বইটা দিচ্ছেন, বিনামূল্যে কেন দেবেন? তাঁর সঙ্গে আপনি কাব্যগ্রন্থ বিনিময়
করতে পারেন, অথবা অবশ্যই টাকা নিন। একজন লেখক আরেকজনের গায়ে পড়ে দেওয়া বই পড়েন বলে
আমার মনে হয় না, অনেক সময় বাড়ি অবধিও নিয়ে যান না, নিয়ে গেলেও কোনো সম্মানিত বইয়ের
পাশে বুকসেলফে রাখেন না।
এই ২০১৬-এ প্রিন্ট পত্রিকা
এবং আন্তর্জালের মধ্যে একটা বোঝাপড়া খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। সম্ভবত কিছু নৈতিক দিক
আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। প্রিন্ট মাধ্যমে প্রকাশিত লেখা অবশ্যই যথাসময়ে আন্তর্জালে আনতে হবে। তাতে সে বৃহত্তর পাঠকের
কাছে যেতে পারবে। কিন্তু সেটা কখন? যখন সেই পত্রিকাটি বিবিধ স্টলে বিক্রি হচ্ছে,
তখন নিশ্চয়ই নয়? যখন একটি পত্রিকা স্টলে এবং ডিস্ট্রিবিউটারদের কাছে পাওয়াই
যাচ্ছে, তখন যদি আপনি আপনার কবিতা বা গল্পকে ফেসবুকে বা অন্য আন্তর্জাল মাধ্যমে
প্রকাশ করে দেন, সেটা ওই পত্রিকার বিপননের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়। পাইরেটেড ডিভিডি বিক্রির স্তরের কাজ ওটা। আপনার কবিতা বা গল্পটির জন্যই
হয়ত ওই পত্রিকা কিছু কপি বেশি বিক্রি হত। শুধু এই খবরটাই তো ফেসবুকে দেওয়া যেত যে,
ওই পত্রিকায় আপনার লেখাটি বেরিয়েছে, যারা আপনার পাঠক তারা স্টল থেকে সংগ্রহ করে
নিত, আর যারা সেটা পারত না, তাদের জন্য পরে লেখাটি তো আন্তর্জালে আনাই হবে! সেটা
যদি না হয়, তাহলে ওই পত্রিকায় আপনি লিখেছেন কেন? শুধু নিজের নাম ফাটানোর জন্য?
অনেককেই দেখতে পাই তাঁরা বিখ্যাত বা স্বল্পখ্যাত
পত্রিকায় লেখা বেরোলে সেটা রাত ভোর হওয়ার আগেই ফেসবুকে পোস্ট করেন। কিছু হাফ
সেলিব্রিটি কোবির মধ্যে এই প্রবণতা বরং বেশি। এটা দৃষ্টিকটু, অনৈতিক, এবং
সংযমহীনতার পরিচয়। একটি সিনেমা যেমন রিলিজের পরেই টেলিভিশনে আসে না, ঠিক তেমনই
লেখাটিকে তখনই আন্তর্জালে আনা যায়, যখন তার কাজ প্রিন্ট মাধ্যমে সম্পূর্ণ
ফুরিয়েছে। সম্পাদকের অনুমতি নেওয়াটাও আবশ্যক মনে হয়। মনে রাখা ভালো, ওই পত্রিকা
এবং ওই সম্পাদক পত্রিকাটি কিন্তু শখে করেন না, ওটা তাঁদের উপার্জনের পথ। অবিশ্যি
এখানে ৫০-১০০ কপির পত্রিকা সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। ওই পত্রিকাগুলো এখনও কেন
প্রকাশিত হয়, ভেবে পাই না। আন্তর্জালের বিস্ফোরণের এই যুগে ওরা লিটিল ম্যাগ নয়,
বরং লিটিল ম্যাগের প্রেতাত্মা হয়ে বেঁচে আছে, সম্পাদকের ব্যক্তিগত স্বার্থ
উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ইগোকে পরিতৃপ্তি দিচ্ছে বটে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে ভূতুড়ে বানাচ্ছে।
সাহিত্য মাফিয়ারা এখন দুটো পথে নিজের
একাধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ১। পুজো সংখ্যায় কিছু কোবির লেখা টাঙিয়ে দিয়ে
তাদের বাংলা কবিতার একমাত্র মুখ হিসেবে পেশ করছে। এঁদের বিবিধ প্রতাপশালী প্রকাশনা
থেকে বইও করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নগন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কিছু অসার নামের
উদয় হচ্ছে যারা পাঁচ অথবা দশ বছর কলার তুলে ঘুরবেন, এবং কিছু দাদার চামচা হয়ে
থাকবেন। এঁদের একমাত্র কাজ হবে প্রকৃত কবি ও কবিতাকে চাপা দেওয়ার জন্য মাফিয়ারাজের
হয়ে সমস্বরে ঘেউ ঘেউ করা। ২। কলকাতা লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় কোবিদের পাশাপাশি কিছু
কবিকেও (কোবি যারা নন) সো কলড আমন্ত্রিত করে তাঁদের জীবনানন্দ সভাঘরে বা
মুক্তমাচায় কবিতা পড়িয়ে নেওয়া, যাতে তাঁরা আরো এক বছর তাঁবেদার হয়ে থাকেন। কোন
মাফিয়ার কোটায় কে কবিতা পড়লেন, সেটা কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় আমন্ত্রণ পত্র
আসার আগে। কিছু শক্তিশালী কবিও এই সুযোগের অপেক্ষায় যথেষ্ট হ্যাংলাপনা করেন, ওখানে
আমন্ত্রণ না পেলে তাঁদের জাত চলে যায়। গত বছর একমাত্র বিশ্বরূপ দে সরকারকে
দেখেছিলাম আমন্ত্রিত হয়েও কবিতা পড়েননি, লিটিল মেলায় উপস্থিত থেকেও, আড্ডা মেরে
বাড়ি ফিরেছিলেন। ‘বাক্’ চিরকাল এই লেখকদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে, এঁদের প্রতি রাখতে
চেয়েছে অকুন্ঠ পক্ষপাতিত্ব। তাই ‘বাক্’ পুনরাধুনিকের পথে।
‘বাক্’ চেয়েছে তার নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী। লেখক এবং
সম্পাদকদের যদি প্রশ্ন করি, একটি পত্রিকার চরিত্র তৈরি হয় কী করে, উত্তর কী দেবেন?
পত্রিকার চরিত্র কি সংগৃহীত লেখা দিয়ে তৈরি হয়? বেশ কিছু ভাল লেখা একজোট করে ফেলতে
পারলেই চরিত্রবান হয়ে ওঠে একটি পত্রিকা? অথবা, কিছু ভাল লেখকের লেখা জোগাড় করতে
পারলেই বুঝি একটি পত্রিকা যুগান্তকারী হয়ে ওঠে? একেবারেই না। একটি পত্রিকা তার
চরিত্র পায় তার নিজস্ব লেখকদের দ্বারা। যে পত্রিকার নিজস্ব লেখক নেই, নিয়মিত লেখার
কোনো লেখক নেই, তার কোনো চরিত্রও নেই। লোকে একসময় ‘ভারতী’ বা ‘সাধনা’ কিনত কারন
সেখানে তারা রবীন্দ্রনাথের এক বা একাধিক লেখা একই সংখ্যায় পেত। লোকে ‘সবুজপত্র’
কিনত রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরীর লেখার জন্য। পাঠক ‘কল্লোল’ কিনত অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত বা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে সেখানে অবশ্যই পাবে বলে। ‘কবিতা’ কিনত বুদ্ধদেবের সম্পাদনা, এবং জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু
দে, অজিত দত্ত বা সমর সেনের লেখার জন্য। একজন লেখক একটি পত্রিকার চরিত্রে এভাবেই
আঙুলের ছাপের মতো হয়ে ওঠেন। ভাবুন তো, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাড়াই কি সঞ্জয়
ভট্টাচার্য তাঁর ‘পূর্বাশা’ বা ভূমেন্দ্র গুহরা তাঁদের ‘ময়ূখ’ প্রকাশ করতে চাইতেন,
করে কি কোনো তৃপ্তি হত তাঁদের? উত্তর হল- না। লোকে ‘কৃত্তিবাস’ বলতে বোঝে
সুনীল-শক্তি-তারাপদ-শরৎকুমারের কবিতা, আর ‘শতভিষা’ মানেই আলোক সরকার আর অলোকরঞ্জন
দাশগুপ্তর কবিতা। ওই নামগুলো সূচিপত্রে না থাকলে পাঠক নিজেকে প্রতারিত জ্ঞান করতেন। কিন্তু
সাহিত্যের এই ইতিহাস জেনে আজকাল আর কজন কথা বলেন? এটাও কি এঁরা ভেবে দেখেন, যদি সত্যজিৎ রায়, জাঁ লুক
গদার, ত্রুফো, বার্গম্যান, আন্তোনিয়নি, বা হিচকক তাঁদের প্রত্যেক সিনেমায়
ক্যামেরাম্যান বদলে নিতেন, যদি একই অভিনেতার উপরে বারংবার নির্ভর না করতেন, একই
ঘরাণার মিউজিক না ব্যবহার করতেন, তাঁদের যে কোনো সিনেমার যে কোনো একটি ফ্রেম দেখেই
কি বুঝে নেওয়া যেত সিনেমাটার পরিচালক কে?
বাজারি সাহিত্যিকরা নতুন প্রজন্মের
বাঙালিদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওঁদের বাস্তবজ্ঞান এবং সাহিত্যবোধ দৈনিক
সিরিয়ালের চেয়েও পিছিয়ে আছে। এক নতুন বাস্তবতা নতুন বাঙালির প্রতিদিনের
স্বাভাবিকতা হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেটাকেই সাহিত্যবাজারিরা ‘ভার্চ্যুয়াল’ বলেই মিথ্যে
করে দিতে চান। সেটা তো নয়। এই নতুন বাস্তবকে ধরার জন্য চাই নতুন লেখক, যার জেনেটিক
কোডে বাংলা বাজারের পোকাগুলো নেই। এখন সাহিত্যবাজারের দালালরা প্রতিনিয়ত ফেসবুককে
আক্রমণ করবেন, কিন্তু সেই আক্রমণ আসলে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার আগে খুব বেশি ঘামের মতো
ব্যাপার। অর্থাৎ শুভ লক্ষণ। বাজার তাকে নিয়েই মাথা ঘামায়, যে তার পক্ষে বিপজ্জনক।
ফেসবুক এখন বাংলা সাহিত্যের সকল সিন্ডিকেট এবং মাফিয়ারাজের অবসান ঘটিয়ে ফেলেছে
প্রায়। সাহিত্যবাজারের মনোপলি ভেঙে দিয়েছে ই-ম্যাগগুলো। আন্তর্জালের কবি হিসেবে আর কারও লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
আপনাদের জয় হোল।
তাই, বাংলা কবিতার প্রথম ব্লগজিন ‘বাক্’ পুনরাধুনিকের পথে।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক বাক্
পরিচালক বাক্
হে পতঙ্গ প্রাণ
পতঙ্গের সুরক্ষা আমি রেখেছি কোণায়... তাও দিও
হলুদ ক্যাপসুল
শিখিনি কিছুই আমি ঝাড়ফুঁক, তাবিজ কবজ এমনকি
পাতাখেলা
ছেড়ে এই ভাষাখেলা, প্রচারভ্যানে অর্শ ভগন্দর
লিঙ্গ বাঁকার
ওষুধ (অবনী জোয়ারদার) ছাপ স্পষ্ট দেখিয়াও আমি
চিনতে পারিনি
নিজেকে মাত্রাবৃত্তে মুদ্রিত একটিও
পুস্তিকামালার সঙ্গে যুক্ত পারিনি
মানত ছিল না শব্দে গুরুভক্তি তাও নয়, তাই এই
মাছিমারা গোড়ালিও
নই সূর্যোদয়ের দারোগা ছিলাম না কোনোদিন
নিঃসঙ্গ ছিলাম কি
২০১৬ সালে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না আমার ঘরে
শুয়ে বসে
এত বেলা অবধি অনুপম আপনি ওঠেন আর দেখুন কেমন
রোদ এসে গেছে কাঁঠালগাছের পাশে অথচ আমার ঘোড়া
শান্ত আস্তাবলে হজম ফোঁটা ফোঁটা পতাকার পুষ্টি
নেই
আলস্যবশত প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের ভেতরে
গ্রুপফটো
বাঁদিকে রজত তার পাশে ডানদিকে ওই তো শ্রীযুক্ত
সম্পাদনা
অবসাদ বাড়ে, একটা নরম রিটায়ার মেডিক্লেম সমেত
বাথরুমে ঢুকে কতদিন পর তুমি একে ভাবানুষঙ্গ
বলবে
নীরব বালিকা কত নিবু নিবু গাছপালা নক্ষত্র
সিংহরাশি
পেরিয়ে ও ভীরু চোখ... পাখি ডাকছে... অড়হর
ক্ষেত দিয়ে
নেমে যাচ্ছে অক্ষমতা... সনির্বন্ধ ক্ষমা
করো... বিমর্ষতা
ক্ষমা করো... সভ্যতার এই তুচ্ছ বীর্যটিকে ক্ষমা
করো...
রোইদ অথবা সে ধুতুরার বিষে
৫
গাঙের ভিতরে ডাকে কুয়াশায় কালকূট বাঁশি
সোহাগ নাগিনী, আয়, হাওড়ে যেমুন দ্যাখে চাষি
ফুটফুইট্যা সোনা রঙ কালিজিরা ধানের বাহার-
নেশা নেশা গুড়ের বাতাসা লাগে মিঠেল চুমার
দুয়ারে লাগাইয়া কপাট কোন্ মন্ত্র বিষ ভস্ম করে?
রূপ খুইল্যা ঢইল্যা পড়ি নাগরের বিদ্যুতের ঝড়ে।
৬
ভরন্ত সোনার সংসারে ক্যান এত হরিণীর পরাণ?
কি কামে তয় পাতায় ডালে সুখের দুই শালিক সন্ধান?
কার লাইগা ভাত রান্ধি? কচি কুমড়ার ঝোল? এইডা কার ঘর?
কিছুই বুঝি না য্যান, আমারে চুবাইয়া মারে অন্য স্বর
কুলা-ভরা বাতাসে দুঃখের ধান উড়ে, কসম
খোদার
ভিজা দেহ বার বার রোইদে শুকাইয়া ভাবি- এই আমি কার?
পুবদেশ থেকে. ৭৮. হাঁটাপথে
গ্রহণযোগ্যতার কথা ভাবি। সুরাপেট ইয়ার্ডের
সন্ধ্যা... বৃষ্টি পড়ছে কি পড়ছে
না! নেহাতই হলুদ আলো জ্বলে আছে কিছু দূরে
দূরে।
দূরে দূরে আরাধনা... দেবীমন্দির... সুরমা
আমিও ওই আলোর মধ্যে ঢুকি
দেখি ছায়া পিছনে পড়েছে
হাঁটাচলা হবহু আমারই মতো এবং
আলোর নিকটে গেলে মুহূর্তে
দৈর্ঘ্যে ও প্রতিভায় কমে আসে তা...
পুবদেশ থেকে. ৯৩. অবসর
অনেক রঙিন
পোশাক কেনাবেচা হল
বুধ ও
শুক্রবারের হাটে
দেশের
ছুটিতে এছাড়াও ছিল
মধ্যাহ্নকালীন
ছায়া
অনেক পুকুর
ও খেজুর গাছের মধ্যে
সকালের
রোদ্দুর
ভগ্ন ও সাদা
আশ্রমের
আশেপাশে দৃশ্যত জড়ো হয়ে ছিল
অগঠিত সমস্ত
উপমা!
পুবদেশ থেকে. ৯৮. পাড়া
ফুল ছড়ানো
হয়েছে রাস্তায়
হিপ হিপ শিস
মুখে
গলিতে শিল্ড
জিতে ফিরেছে ছেলেরা
সন্ধের
মুখ...
দু-একটি ঘরে
প্রদীপ জ্বলেছে
পাটিগণিত ও
ব্যবহৃত ব্যকরণ বইতে লন্ঠনের আলো;
এমনকি পড়ায়
মন উঠে গেছে
মাস্টার
এসেছে কি আসেনি তখনও
নাইটিঙ্গেল
এভাবে যাবে
না
নদী যায়
বিছানা পেরিয়ে
স্টেথোস্কোপ
পার হয় নাঙ্গা পর্বত
কু কাটলে কি
হয়
চাদর পালটে
দিলে কি হয় কু-এর
জানলাগুলো
গাছ হ'ল
তাহাতে কোকিল
বসলে
দেখছো তো
পর্দা উড়ছে গাছে গাছে
শোয়াবারি
দেখছো তো
শিকড়মুখীন
মনসুন
পথে পথে অক্সিজেন
পলে পলে
মাস্ক ক্যাথিটার
এভাবে যাবে
না নাইটিঙ্গেল
জোনাকির
ডিপার ডিমার
জানলার
শিকগুলি এলো ব'লে
ট্রেন প্লেন
পত্রপল্লব আর মুসম্বি সমেত
ওটি
যে এলো আলোয়
তাকে জন্মদিন
দাও
খুব বরফ থেকে
বেরোলো ছুরি কাঁচি
ভ্যানিলা
স্ট্রবেরী তারা পরাবাস্তব
রক্তমাখা রূপং
দেহি
যা নোনাই, লবণাম্বু যেই
তাকে জন্মদিন
দাও
কতদূর কোঁকড়া
চুলে বসেছিলে
আর ডিগবয়
থেকে রক্তসরণী
গ্রেটার
কৈলাশ থেকে দেওদার নিঃশ্বাস
জুতোর তলায়
ফাটছো চড়াই রুকস্যাক
পত্রবোমা
মাঝঘুমে মধ্য মিনিটে
জানো নাই
গ্রাফে
গ্রাফে অচেনা অক্ষর
টবে টবে
শুকনো ফোনকল
সুদূর ডুয়ারস
থেকে রওনা হয়েছিল আলো
জন্মদিন
এস-ফোর লোয়ার বার্থে
তার চিঠিগুলি, বেজে উড়ে বাস্প হয়ে যায়
দিন
দূরের হলুদ জানালায়
কুসুমে টলমলে ছায়া দোলে
পর্দার ফিনফিনে সাদা, ভেতরে তরল এক ঘর
কুটি কুটি কিছু মিছু ভ্রূণ
পড়শীরা গড়েই ওঠেনা
তারও আগে নিভে যায় আলো
অবিচ্ছিন্ন স্রোতে সারা রাত
শহরে একটাই নদী বয়ে চলে অবিরাম
চূর্ণ হয়ে বড়রাস্তা থেকে
ছিটে ছিটে আলো তার আকাশকে দিন করে রাখে
আলোর ভেতরে আলো ঝাপসা হয়ে আসে
নরম পর্দার নিচে ঘন হয় পড়শীরা,
ডিম ফুটে জেগে ওঠে আরও গাঢ় সান্দ্র এক দিন
চম্পুকাব্য
শীত নামে আর বিকালবেলার চারা বিছরা আমাদের মন টানে। আমরাও দল বেঁধে হরতন-রুইতনের প্রেমে
পড়তে চাই। পুবের
বিলে রাত জেগে শুনতে চাই মালজোড়া, পীরমুর্শিদী গান। এতসব আমরা পারি না। গার্জিয়ানদের কড়া নজর আমাদেরকে
কান ধরে পড়ার টেবিলে বসায়। আমরা ‘যে জন দিবসে মনের
হরষে’ জপতে জপতে গলায় রক্ত তুলি।
কিন্তু এতেসব সুজা ভাই পারে। আর পারে বলেই সে হিরো হয়। দক্ষিণ পাড়ার কমলা আপার
প্রেমে সে ফানা হয়, কিন্তু সফল হয় কি না আমরা তা বুঝতে পারি না। আমরা দেখি কমলা আপার হঠাৎ
বিয়ে হয়ে গেলে গাঞ্জা খেয়ে সুজা ভাই পাড়ার টং দোকানে হৈ চৈ করে, আর ঝিম মেরে থাকে।
একদা আমরা বিদ্যালয়ে যেতে এও দেখতে পাই আমাদের হিরো সুজা ভাই
চৌরাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোলে ব্যস্ত। জগতের এত এত যানবাহনের নিয়ন্ত্রন তার
আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকলে দিন শেষে আমাদের সুজা ভাই গ্রামে ফিরে
রাত পাহারায় নিয়োজিত হয়। আমরা তখনও সুর করে পড়তে থাকি : ‘কাঁটা হেরি ক্লান্ত
কেনো কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে’?
২
আর ভাবি, একদিন মক্তবঘাটের সবাইকে শুনিয়ে ঠিকই পাড়ায় পাড়ায় গল্প
হয়ে উঠব। তখন
হয়তো আশ্বিনের শুরু। দূরে তাকালেই সন্ধ্যার গায়ে কুয়াশা জমতে দেখা যাবে। হয়তো তখন আশ্বিনের শেষ। পুবের বিলে হলহলা ধানক্ষেত
ভিজে উঠবে গোধূলি আলোয়। আমরা শুকনো আলের ধারে বসে বসে হিমশীতল ধানগাছগুলো ছুঁয়ে দেবো
উচ্ছলতায়, কুয়াশানামা সন্ধ্যায়। না-হয় তখন ভাদ্রই হলো। রোদবৃষ্টির উমতানিতে ঘেমে
উঠবে পড়তি বিকেল। সোনা
ঝরা চান্দিনা ক্ষেতে উড়ে বসবে গোয়ালগাদ্দা ফড়িং। হয়তো বা পৌষের বিকেল। শিম ঝাড়ে ফুটে আছে ফুল, কুয়াশা কুহক। চৈত্রও তো হতে পারে। শিমুলের ডালে শালিকগুলো
ঝরাবে আগুন। বারিষাও
হতে পারে। চেনাজানা
পানাফুল, জারুলের গাছ, বিলের শালুক, হিজলের ডাল, পদ্ম ফোটা ঝিল হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে
যাবে। অঝোর
ধারায় না-হয় ঝরলো বৃষ্টি সাতদিন। মাঘও তো হতে পারে। হোক। নাড়ার আগুনে ওম নিতে নিতে
পড়ব, পড়তেই থাকব। জলছাপ দেওয়া পাতায় লিখবে সে ‘যদি হয় সুজন,
তেঁতুল পাতায় ন’জন। যদি থাকে ভালোবাসা, এক বালিশে দুই
মাথা’।
ভাবি, একদিন পাবই সে-চিঠি,
প্রেমপত্র, গোপনীয় ডাক, নিষিদ্ধ কামনা।
নিকানো
বাড়ির সামনে
দিয়ে চলে যায়নি
সাদা কাচের নদী।
সারিয়ে নিলাম
ভাঙা চশমা।
রঙের পিঠে
হাত বুলিয়ে তাকে নিরাময়ে আনি।
একঝাঁক চিঠি।
উড়ছে
এয়ারোড্রোমের সন্ধেবেলায়।
সারা জীবনেও
নতুন জমানো কারোর খবর
কোনও নক্ষত্র
বা হলুদ পাতার কাছে
পৌঁছে দিইনি।
ওখানেই তো
মাধ্যাকর্ষণের শেষ।
খুল যা
সিমসিম গান গেয়ে
সূচ ও সুতো
আধখোলা চোখে
দেখে নিজের ভবিষ্যত।
মাউস-বৃক্ষ
থেকে ইঁদুর নেমে
অনুবাদ করে
কমপিউটরের মরচেগুলো।
রাত্রিবেলা সরসবতী
বৃষ্টি মেখে
শরীর ধুচ্ছে শরীর থেকে।
প্রস্তাবনা
বালিকা জলের
কাছে।
চুল ছড়িয়ে
দিলে চাঁদ ও কুঠার উঠে আসে।
বাংলাশব্দের
এই থ্যাঁতলানো টিকটিকি।
অস্পষ্ট জল।
তা কি নিজেরই
ইচ্ছায়?
উড়ে আসে একে
একে।
টেবলে জড়ো
হচ্ছে, রূপকথার মিথ্যে
ছায়ারা।
গোলাবাড়ির প্রতিধবনি
এবং
স্কুলিং-ও তাহলে শেষতক এলো!
দ্বিতীয়
পৃথিবীতে ভালোবাসা শুরু হয়।
মা শুরু হয়।
পুরানো দিনের
গান গাইতে গাইতে
শুঁয়োপোকা
ওষুধের দোকান খোলে।
সারাদিন
হাঁটার পর একোরিয়ামে মাছ
জুতো খুলছে।
সকালবেলা অলক্ষ্মী
লাবণ্য
লাবণ্য বলে ডাকছে পৃথিবীর শূন্যগুলিকে।