Wednesday, September 28, 2016
নিবিড় পাঠে কবিতাডিহি
আলোচনায়: নবিন দাস
২০১৬ কলকাতা বইমেলা – বাঁকুড়ার ‘কবিতাডিহি’ থেকে প্রকাশিত
হল এক ফর্মার সাতজন কবির সাতটি কবিতার বই। ভাষায় ভিন্ন হয়েও আধুনিকতার এই সাতসুরকে
ছুঁয়ে দেখতে দেখতেই কখন সরগম বেজে ওঠে হৃদয়-তন্ত্রীতে। প্রিয়
পাঠক আসুন আমরা ডুব দিই এই নতুন সুরের ঝর্ণায়।
পেঁয়াজ খেতের কবিতা ।। সুবীর সরকার
উৎসর্গপত্রেই চোখ আটকে যায়, বোঝা যায় বিচিত্র সব মানুষ
জড়িয়ে আছেন কবির জীবনে; আর এই নিয়মিত চর্চার নিবিড় রেশটুকু পাওয়া যায়
কাব্যগ্রন্থের ১২টি কবিতায় – পেঁয়াজের মত এক একটি খোসা ছাড়াতে ছাড়াতেই যার রূপটান।
দৃশ্যকাব্যের ভাঁজে ভাঁজে এমন রৌদ্র লুকোনো, বাঁশি বাজানোর মত এমন পেলব সুন্দরতা
চাঁদের আলোর মত ছড়িয়ে রয়েছে কবি ও কবিতার ঘর-গেরস্থালীতে। হাওয়া সাঁতরে পাখিরা /
এগোতে এগোতে নদী - এভাবে যে দোতারা বেজে চলে সমগ্র কবিতা জুড়ে তাকে দু-এক কথার লেখনীতে নয়, পড়েই অনুভব
করতে হবে পাঠককে।
বিভ্রম রঙের মেঘ ।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
আধুনিকতার সব ভাষা ছুঁয়ে যাওয়া বড়ই কঠিন, মনে হয় পাশাপাশি
চলে যায় রেললাইনের মত; তবু কোন কোন বিস্তার ঘুঙুর হয়ে বেজে ওঠে উন্মাদ প্রহরগুলিতে। নিরক্ষর সাদা
কাগজের লাশগুলি যেভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, মানচিত্র এঁকে চলে আদিগন্ত জুড়ে শরীরের
সমস্ত স্পর্শ দিয়ে তাকে ছুঁয়ে যেতেই হয়। কবির ১৫টি কবিতায় বারবার ছন্দে নেচে ওঠে
মুগ্ধতা, মেঘ কিম্বা মেঘলা দুপুর পেরিয়ে যা ছড়িয়ে পড়ে সকল সূর্যাস্তে; আরও দীর্ঘ বেঁচে থাকা কবিতাযাপন টের পাওয়া যায়। পুরো
কাব্যগ্রন্থকে যদি এক অক্ষে দাঁড় করানো হয় তবে তার সুতোয় নিশ্চয় লেখা থাকবে
কাদামাখা হাত কল্পনার মানচিত্র আঁকে নির্ভীক। বিভ্রম রঙের মেঘগুলি দিয়ে এমন ছবি
আঁকার কথা আর কে-ই বা ভাবতে পারে কবি ছাড়া।
মুষলপর্বের স্বরলিপি ।। বিশ্বজিৎ লায়েক
উৎসর্গপত্র থেকেই কবি ভালোবাসায় ঘৃণায় সামিল হয়েছেন, রাত্রি থেকে সকাল ছুটে বেড়িয়েছেন,
খুঁজে ফিরেছেন বৃষ্টি থেকে বীজের দিকে। প্রথম কবিতার ১ থেকে ১৮ পর্যন্ত এলেও এই
টানাপোড়েন, মাঝে মাঝে হোঁচট খেতে হয় তবু রঙমিলান্তি বিস্ময়ের কাছে। নাতিশীতোষ্ণ
শ্রমের যাপন পালটে যায় গল্পান্তরে। মনে হয় সমে এসে ঠিক থামে না যেন, আবার অনন্ত
যাত্রাও হয়ে ওঠে না। ইস্পাত শহরে এসে গ্রামের দরজায় কড়া নাড়তে চাইলেও আদিম পৃথিবীর
ক্ষুধা কোথাও অসহায় হাহাকারে ভরে। অগস্ত্য যাত্রা কবিতাতেও ১ থেকে ৬ পর্যন্ত
হাঁটলে এই পালিয়ে বেড়ানো দূরে দূরে হাঁটা – মনে হয় কবিতার নাম ‘বিবাহ সংগীত’ হলে
ক্ষতি কী ছিল, সেখানে বরং এক অগস্ত্য যাত্রার দিকে যেতে পারতেন কবি।
স্পর্শজ সুখকথা ।। ভজন দত্ত
সুদীর্ঘ পথ চলতে থাকলে মাঝে মাঝে পথ বদলে নেওয়া ভালো,
আপাত থমকানো মানে শেষ হওয়া নয় – অবলীলায় ভেসে যাওয়ার আগে এক অনলস প্রতীক্ষায় থাকা;
কারণ স্পর্শজ সুখের কথা বলে চলেছেন কবি, যে অভিজ্ঞতায় মিশে রয়েছে সাঁতার শেখা জীবন
কিম্বা তুলসীতলার সাংসারিক কথোপকথন অথবা গৃহস্থে পরম উল্লাসে মাংসের ভোজ। বুকের ভিতরে রাখা
সুখ স্মৃতিগুলি হাতড়ে খুঁজছেন কবি, আর আমরা হাত
পেতে আছি অতখানি স্মৃতি এখনো পাইনি বলেই। ১৮টি কবিতা জুড়ে এমন বহুমাত্রিক বিচরণ
খুব সহজ কথা নয়। প্রতিটি অশ্রুপতনের শব্দ শুনতে কিম্বা পদপিষ্ট তৃণের ব্যথা বুঝতে
তো আমরাও চাই, তাই কবির অস্থিরতার জিজ্ঞাসায় সামিল হই – আমার নির্লজ্জতা চিরন্তন
পানকৌড়ি হয়ে ডুব দেয়।
কাগজের হারপুন ।। অনিন্দ্য রায়
‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি’ – এভাবেও ভাবা
যেতে পারে। কারণ কুড়ি বছরেরও আগে লেখা কবিতাগুলির সাথে এভাবেই দেখা হয়ে যায় কবির,
নাহলে এমন কাগজের হারপুন কিভাবেই বা তৈরি হয়। তবু চন্দ্র করোটির ভাষা বুঝে উঠতে
পারে না ঠিক অপরিকল্পিত মন। অক্ষম ভাঙা কাচে কিভাবে যে জ্বলে ওঠে প্রাথমিক মোম;
হাততালির শব্দে উড়ে যায় ক্ষণস্থায়ী বক। চারটি যৌগিক কবিতা পড়া হয় মধ্যরাত্রে, অথচ
মনে হয় জন্মান্তরহীন পাথরে অবিরাম ধাক্কা খায় নামফলকের কাঠ। অমানুষিক পিপীলিকা
শ্রেণীর জীবনপ্রণালীতে কতখানি সপ্রতিভ বাংলা লিরিক, কতটুকু গোপনীয়তা জটলা করছে
অধাতু দিয়ে বানানো শহরে – পাঠক খুঁজে দেখুক অন্তরীক্ষের এই দীর্ঘ সূচিপত্রগুলো।
হাওয়ার স্ট্রেচার ।। সুজিত পাত্র
উৎসর্গপত্রেই শুধু নয় বিগত ডানার কথা ছড়িয়ে আছে পাতায়
পাতায়, তাই নৌকা বানানোর ডাক শুনতে চায় অলস অভ্যাস। এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয় শুধুই
অতীতচারিতা, তবুও বুকের মধ্যে স্থির প্রত্যয়ের মত জেগে থাকে নির্বাক মাস্তুল। কবির
ইচ্ছায় মুখের নিব ভেঙ্গে চমৎকার মুক্তগদ্য, আহা! মান্দাসে ভেসে চলে পিছুটান। তবু
মনে হয় আগামীর সব হিসেব তুলে না রেখে কিছু ইস্তেহারের সন্ধান দিলেই ভালো ছিল। কবির
বারান্দায় তরঙ্গের ভাস্কর্যে যত হাওয়ার কানাকানি – বানান ভুলে কিনা জানি না –
সারারাত ধরে তৈরি খোলসও বারবার ভেঙ্গে যায় মনে হয়। ৭ নং কবিতায় ‘স্বাভাব’ বা ৯ নং
কবিতায় ‘কেলো পিছু একরত্তি দম দিয়ে যাও’ বত্রিশ কলায় পূর্ণ হল কী। দৃশ্যের খোঁজে
খোঁজে কতটা নূপুর পাঠক খুঁজে দেখুন।
মুজরিমপুর ।। সুদীপ চট্টোপাধ্যায়
কবিতা লিখতে বসে না-কবিতা লেখার কাজটা খুব কঠিন নয়, যতটা
কঠিন না-কবিতা গুলিকে এক-একটি নিটোল কবিতা বানিয়ে তোলা। প্রতিটি কবির কবিতার ভাষা
হয় নিজস্ব, তবু কোন কোন গ্রন্থের সব কবিতা এক সুতোয় বাঁধা থাকে না। তাই মুজরিমপুরে
যতখানি তাপ-সহচর মৃদুল মৃদুল, যৌগিকস্পর্শে অন্য দেশ গ্রাম জ্যোৎস্নাশহর। তবু গলিত
মোমের শিখায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা হিম, ঘুমপাখি, নবীন স্তবক। দু-একটি
পুষ্পআঁধার যেভাবে ঘুঙুরে ছড়ানো এমন কোরাস - কবিই তো মেলে রাখেন একান্ত শীতের মত। তাই তো তরল উঠোন
গলে গলে পড়ে। প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি, অথচ স্বপ্নচরিতের কথা কিভাবে বলা যায় – এমন
নিবিড় উত্তাপ হাওয়ার স্পর্শ আহা পাঁজরে লুকিয়ে থাক অসীম ভ্রমণ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment