• গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ও তুষ্টি ভট্টাচার্য
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - সোনালী চক্রবর্তী
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।

  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস
  • ধারাবাহিক উপন্যাস


    বঙ্কিমচন্দ্র


    অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত

Wednesday, September 28, 2016

বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত




বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত
 [পঞ্চম পর্ব]

‘জঙ্গল তোলপাড় ক’রে চলা হাতি
নিজের রাস্তাটা উপড়ে ফেলছে না’  
—‘এই পৃথিবীর নাভির দিকে’, কো কো থেট

অমিয়ভূষণ মজুমদার
আমরা যা দেখি, যা শুনি, যা বলি তা অনেকগুলো ভাবনারই ফল। আউটপুট। ভাবনাকে শরীরেরই পরিবর্তিত রূপ হিসেবেও দেখেন অনেকে। কিন্তু স্বয়ং ভাবনাটিকে আমরা কেউ দেখিনি। ‘ভাবনা’—পুরোটাই এক বিমূর্ত ভাবনা। নেই। কিন্তু আছেঅথচ নেই। অতএব আছে। পৃথিবীর জল হাওয়ায় জন্ম নেওয়ার আগেই তো আমাদের অন্তর্গত অধিভূত ও অধিদৈবতের জন্ম হয়ে গেছেনয় কি? যখন ভ্রূণ হয়ে আছিমস্তিষ্ক জন্মাচ্ছে না তখন? প্রাণিমাত্রকেই অধিকার করে থাকে যা—সেই মৌল রাশি ও পদার্থগুলি কি তখনই সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে না? ঠিক যে মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক কাজ শুরু করল, ঠিক যে-মুহূর্তটা, তক্ষুনি কি আমাদের জন্ম হল না? নাকি ঠিক যখন আমার মস্তিষ্ক ভাবতে শুরু করল? নাকি যেদিন মায়ের যোনি থেকে বা পেট কেটে আমার এই শরীরটা বের ক’রে আনা হল, সেদিন? অথবা, যেদিন থেকে আমার স্মৃতি স্মরণযোগ্য হতে শুরু করল? যেদিন আমি প্রথম কিছু মনে রাখলাম? কোনটা আমার জন্মমুহূর্ত? নাকি শ্বাস নিলাম যখন প্রথম? কিংবা যখন জাইগোট তৈরি হচ্ছে? নাকি এর কোনওটাই নয়, যখন গোনাড অঞ্চলে মুলেরিয়ান বা উলফিয়ান ডাক্‌ট থিতু হচ্ছে? আমি কোনখান থেকে শুরু করেছিলাম? আমি দৌড় শেষ করতে চলেছি, কতখানি দৌড়লাম তার কোনও রেকর্ড থাকবে না কোথাও?
আমরা যে এত মুক্ত হতে চাই, অদ্ভুত, এটাই তো ভাবিনি আমার ফেলে আসা সবক’টা আমিই তো তারিখের শেকলে ঘটনার বেঁধে রাখা পা। আমিই তো সেই পা। ঘটনার পা। ক্যালেন্ডার দাঁড়িয়ে থাক তার তারিখ নিয়ে। মানুষ হোক কি ঘটনা, তার অধিদৈবত তারিখ ছাড়িয়ে চলে যাক অন্য কোথাও।      
কিন্তু ব্যাপারটা হয়ত এরকম হবে না। যে কয়েক কোটি বছর ধরে আমাদের মনের নানান অলিন্দ ও প্রকোষ্ঠগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রিমিটিভ পরিবেশে বিবর্তিত হয়েছে, তাকে চিনবার জন্য আমাদের মনের আদিম ক্ষমতাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে না তো? যে গতিতে সিভিলাইজেশন এগোচ্ছে, যে গতিতে সমস্ত আদিম চিহ্ন ও স্থানগুলোকে উৎখাত ক’রে জঙ্গল সাফাই চলছে, ডিনামাইট ফাটিয়ে বক্সাইট তোলা হচ্ছে, যে গতিতে আরও গতি অর্জন করছি আমরা, তার ধারেকাছের গতিতেও কি আমাদের মস্তিষ্কের বিবর্তন হচ্ছে?  

[এটা এমন একটা প্রজন্ম, যে মিরর এফেক্টটাকেই ট্রুথ বলে জানবে। এবং সেই ট্রুথকে আলটিমেটাম আনকোশ্চেনবলটিউবওয়েলের হ্যান্ডেল দেখলেই মনে হয়, এ যেন হাত তুলে বলছে ‘শার্টের হাতাটা গুটিয়ে দাও না’হাতা গোটাবার জন্য বাঁ হাতটা তুলতে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলের মতোই লাগল নিজের হাতটা। বঙ্কিমের। হাসি পায়। মনের ভেতর কখন যে কী এসে ফণা তোলে, হাসতে-হাসতেই মনে পড়ে, অরুণেশের সাথে বড়ু চণ্ডীদাসের দোকান। বাঁশের মাচায় লেঙুট পরা এক লোক, চোয়াল দু’টো ভেঙে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। গালের দু’পাশে গ্রীষ্মকালীন খরাসর্বস্ব দু’টো পুকুর যেনতাদের তলদেশ বুঝি মুখের ভেতর একে-অপরের প্রান্তভূমি চুম্বন করেছে। (বোধহয়) একটিও দাঁতহীন সেই বুড়ো হেসে চলেছে। হেসেই চলেছে। সে কী হাসি তার। ভ্রূক্ষেপহীন নির্বিকার সে হাসছে। সতীর বিভিন্ন অংশের মতো তার হাসির এক-একটা টুকরো যেন বিকট কদাকার খাবলা-খাবলা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশ, মানে এই ভূমানসখণ্ডে। কুলকুল ক’রে হাসতে হাসতে সে শুধুই বলছে, ‘পুটকি মাইরা দিসিরে—সব খায়্যা ফেলসি পাচ বছরে—সব খায়্যা ফেলসি—সব শ্যাষ...’ ওফ, সে কী বিদ্রূপ। বিশালাক্ষী এক দেবী যেন হাসছেন তাঁর সর্বাঙ্গ ঝাঁকিয়ে, আর তাঁর সেই দানবীয় হাসির সামনে স্তম্ভিত পাথর হয়ে ব’সে আছে গোটা অসুরকুল, নরকুল, দেবকুল। এক চাষি যেন তার গোলাভরা শস্য রেখে বিভূঁই গেছিল। ফিরে দ্যাখে, পোকা আর ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে সব শস্য। গোলা এখন শূন্য। ইঁদুরের ভুক্তাবশেষ হয়ে প’ড়ে আছে ছড়ানো খোসা। খাঁ খাঁ প্রেত-পাতালের মতো সেই শূন্য গোলা দেখে চাষি কিন্তু কাঁদছে না। তার অধিদৈবত হাসছে। হো হো ক’রে হাসছে। চণ্ডীদাসের দোকানের বুড়োটা ঠিক ওই চাষার মতো হাসছিল। চাষার অন্তর্গত প্রেতের মতো। দেবতার মতো। হা হা।]     

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়    
আমি, বঙ্কিমচন্দ্র। এই উপন্যাসের চরিত্র। শুধু আমি নই। মার্কেজ, বড়ু চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ, কমলকুমার, ঋত্বিক, সন্দীপন, নবারুণ, আখতারুজ্জামান, অমিয়ভূষণ, বীরসা মুণ্ডা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এঁরাও আছেন। এবং আরও কেউ কেউ। কিন্তু আমরা এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নই। অন্তত চালিকাশক্তি তো নই-ইআমাদের ভূমিকা সত্যিই সামান্য। খবরের কাগজের রিপোর্ট, দু’শো কি পাঁচশো বছর আগের কোনও চিঠি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সতর্কবার্তা, দেশভাগের সময়ের কোনও আর্টিকেল, সংবাদপত্রের শিরোনাম, শহর জুড়ে পোস্টার, নিধুবাবুর জলসা, দেবব্রতর গান, কোনও কথোপকথন, হিস্‌সা-সঙ্কুল স্বদেশ, এজমালি স্বদেশ, পোঙায় মধু, মন্ত্র, মালা ও দর্পণ—কখনও এঁরাই হয়ে উঠেছেন প্রধান চরিত্র। আসলে ‘সময়’ বোধয় একমাত্র চরিত্র এই উপন্যাসের। আমরা সবাই মিলে তাকে নিজের মতো ক’রে সাপোর্ট করেছি। ঠিক সময়ও নয়, একটা সময় থেকে আরেকটা অন্য সময়ের মাঝখানে যে গুপ্ত দরজা, যেখান দিয়ে এক কাল থেকে আরেক কালে যাওয়া-আসা সম্ভব, সেই দরজাটাই এই উপন্যাসের প্রধানতম চরিত্র ও চালিকাশক্তিঅথবা এটা একটা অতিপ্রাকৃত বা সোজাসাপটা ভূতের গল্প। যেহেতু এই উপন্যাসের কোনও ঔপন্যাসিক নেই, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি যিনি এখানে ঔপন্যাসিকের চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। তাই আমাদের নিজেদের কথাগুলো আমাদেরকেই বলতে হচ্ছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে অনাথ চরিত্র, আমরা। প্রকৃতপ্রস্তাবে অভিভাবকহীন। তথাপি, কাজে সুবিধে হওয়ার জন্য, আমরা একজন ন্যারেটর নিযুক্ত করেছি। আমরা যখন নিজেদের কথায় ও যাতায়াতে ব্যস্ত থাকব, তখন ইনি বাহ্যিক ও মানসিক ঘটনাক্রম আপনাদের জানিয়ে যাবেন। উপন্যাসে এই ‘ন্যারেটর’ মানুষটিই হলেন একমাত্র জীবিত চরিত্র। এমন একটা খেলার মাঠ কল্পনা করা যাক, ওয়াংখেড়ে বা লর্ডসযেখানে খেলতে নেমেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের বিভিন্ন মৃত এবং মহান খেলোয়াড়রা। মৃত বলেই তথাকথিত স্থূল জগতে যাঁরা আর চলে-ফিরে বেড়ান না। হাত ঘুরিয়ে ওয়ার্ম-আপ করতে করতে মাঠে নামেন না খেলতে। তাঁরাই খেলছেন মাঠে নেমে। খেলার তারিখ ও সালটি আজকের। কোনও কোচ নেই যে টীমে। কোনও কোচ হতে পারে না যে টীমের। মৃতের অভিভাবক হওয়ার যোগ্যতা কার আছে। কার থাকতে পারে। ‘ওন্‌লি দ্য ডেড ক্যান রাইট দ্য লাইফ হিস্ট্রি অফ দ্য ডেড। দ্য লিভিং ক্যান ওন্‌লি স্টাডি। ইউজুয়ালি, ইউ ক্যান স্টেয়ার লাইফ ইন দ্য ফেস হোয়েন ইউ আর আউটসাইড ইট’তবে, একজন ভাষ্যকার আছেন। তাঁকে দেখা যাচ্ছে নামাঝেমাঝে তাঁর গলা শুনতে পাব আমরা। এটুকুই। বলা বাহুল্য, এই ভাষ্যকার কোনও মৃত চরিত্র নন। ইনিই আমাদের স্বনির্বাচিত ন্যারেটর। ইনি জীবিত। আর জীবিত, আপনারা

দেউলটি, মেল্যক
কাল, মাঝ-রাত অবধি দেউলটিতে। দিগন্ত পর্যন্ত ফাঁকা একটা মাঠ। চাটাই বিছিয়ে। পাঁচজন। বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, শরৎচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের ভগ্নিপতি রমলাকান্ত (ইনি কালীপ্রসন্নর বাবার বিয়েতে নীতবর হয়েছিলেন ব’লে জানা গেল কালই), আর মধুসূদন দত্ত। হাতে হাতে পাঁচ-পাঁচটা বাঙলার বড়ো খাম্বা। হু হু ক’রে হাওয়া আসছে চারদিক থেকে। পূর্ণিমা শেষের আধভাঙা চাঁদখোলা আকাশ। তারা ভরা। বঙ্কিমচন্দ্র আর কালীপ্রসন্নর ভয় খালি আলখরিশ আর চন্দ্রবোড়া নিয়ে। সেই অন্ধকারেই পাম্প স্টোভ জ্বালিয়ে কড়াই চেপে গেল। তাতে রাঁধা হ’ল একটি হাঁসের মাংস। এটার জন্য সমস্ত কৃতিত্ব মধুসূদনের। বঙ্কিমচন্দ্র আর কালীপ্রসন্ন অবশ্য ডাহুক কিংবা কচ্ছপ কিংবা চিতি কাঁকড়া কিংবা গেড়ি গুগলির প্রস্তাব রাখেনকিন্তু মধুসূদনই প্রথম প্রস্তাবিত হাঁসটিকে থালা অবধি পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন শীতকালেই হাঁসের মাংস সবচেয়ে সুস্বাদু হয়। এঁদের মধ্যে একমাত্র শরৎচন্দ্রই নিয়ে গেছিলেন লেখার খাতা। অনেক কষ্টে উনি বোধয় খান দুয়েক লেখাই পড়তে পেরেছেন। তারপরে ওঁকে আর পড়তে দেওয়া হয়নি। তুমুল হৈ-হল্লা, ঝগড়া করেছেন কালীপ্রসন্ন আর বঙ্কিমচন্দ্র। সিপিএম আর মাওবাদী রাজনীতি নিয়ে। গান্ধী আর মার্ক্স নিয়ে। কালীপ্রসন্ন প্রথম পক্ষে। বঙ্কিম দ্বিতীয়। শরৎচন্দ্রের বাড়ির কাছেই পাঁচজনের এই অভিসার। গ্রামটাকে তাঁর উপন্যাসের মতোই লাগল, এখনও। পুরনো বাড়িদোকান। রাস্তা। গাছ। জঙ্গল। চেনা চেনা বড্ড। হঠাৎ কালীপ্রসন্ন গান গেয়ে উঠলেন।
কাস্তে চলে আস্তে আর হাতুড়ি দুর্বল
তারা পথহারা সিপিএমের চোখে জল
এসো ক্যাডার নিয়ে ড্যাগার যতই করো তুমি ছল
মিলে মিলে দলে দলে বাঙলা উজ্জ্বল।  

নবারুণ ভট্টাচার্য
সিনেমা-থিয়েটারে সাধারণত যেমন হয়, অভিনেতারা আগে থেকে জানেন সবকিছুকখন কোথায় কী ডায়লগ হবে, কী পজিশন নিতে হবে, ক্যামেরা বা লাইটের অ্যাঙ্গেল কী হবে, এরপরের দৃশ্যে কে আসবে, কে যাবে—সব তাঁদের জানা। তাঁদের জানানো হয়েছে। নিজেদের কাজ সম্পর্কে কিছুটা হলেও তাঁদের অ্যান্টিসিপেশন থাকে। থেকে যায়। জীবনের বেলায় তা হয় না। জীবন, অননুমেয়। কিন্তু এই উপন্যাসে, আমরা, যাঁরা অংশ নিয়েছি, প্রত্যেকে জানি কার কী কাজ। কে কোথায় দাঁড়িয়ে কী কথা বলবে, উলটো দিকের মানুষটি কী উত্তর দেবে বা প্রশ্ন করবে—সবটাই আগে থেকে ঠিক ক’রে নেয়া। প্রি-প্ল্যানড। নির্মিত। প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি বাঁক—পূর্বপরিকল্পিত। পুরোটাই ফ্যাব্রিকেশন ছাড়া কিচ্ছু না। মিস্ত্রীর কাজ। আবেগ-টাবেগের কোনও ব্যাপার নেই। আমরা জানি এরপরের দৃশ্যে কী হতে যাচ্ছে। কোথায় আমরা ঝাড় খাব। কোথায় রক্তপাত ঘটবে। কোথায় হেরে যাব। সব জানা। 
কিন্তু এটা ঠিক, বস্তুর প্রকৃতির ওপর আমাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি একটা পর্যায়ের পর সীমাবদ্ধ। একটা পর্যায়ের পর আমরা আর জানব না এরপর কী হবে। তখনও এমন কিছু থাকবে, যা আমরা দেখতে পাব না। এমন কিছু শব্দ হবে, আমরা শুনতে পাব না। এমন ঘটনা ঘটে যাবে, আমরা তার কোনও রেকর্ড রাখতে পারব না। এরকম সময়েই তো আমরা ছবি আঁকতে বসি। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের মাঝখানে যে ফাঁক সেটা তখনও রয়েই যায়। সেই ফাঁকটাই উস্কে দেয় আরও নানান বিভিন্ন সম্ভাবনার থাকার সম্ভাবনাকে।

পাঁচজনের হাতে তখন ঘুরছে তামাকের জয়েন্ট। গ্লাসে গ্লাসে বাঙলা। থালায় হাঁসের মাংস। এদিকে তর্কে যোগ দিয়েছেন রমলাকান্তও। একসময় তিনি ব’লে ওঠেন,
—‘আজ্ঞে, আমার আপনার দেশের বিপুলভাবে জিতে আসা সরকার বজরং দলের নয়। নয় কোনও পরদেশী ভাবধারায় আধারিত কমিউনিস্ট দলের। এ’ হ’ল সম্পূর্ণ ভারতীয় ভাবধারার বহুজাতিক, বহুভাষিক ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার 
বঙ্কিমচন্দ্র এতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বাঁ হাতে বাঙলার গ্লাস আর ঠোঁটে তামাকের জয়েন্ট নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। তারায় ভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন,—‘আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন একটি বই লিখেছিলেন। হিন্দু ধর্ম নিয়েপেঙ্গুইন থেকে বেরিয়েছিল বইটি। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের অনুরোধে এই বইটি লিখেছিলেন আচার্যসাম্প্রতিককালে বইটি আনন্দ থেকে বেরিয়েছে। অমর্ত্য সেনের একটি অনবদ্য ভূমিকা সহমাসখানেক আগে পড়ছিলাম বইটি। এবং মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পড়া হয়ে গেল এত বিস্তৃত বিষয় নিয়ে লেখা বইটা। হতাশই হয়েছিলাম প’ড়ে। অচেনা অজানা দিকে কেন আলো ফেললেন না হিন্দু ধর্ম নিয়ে এর’ম পণ্ডিত একজন মানুষ প্রতিটা পাতাই পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল গ্র্যাজুয়েশন লেভেলে ইন্ডিয়ান ফিলোসফিতে প’ড়ে এসছি। না, বইটির নিন্দে করার জন্য এত কথা বলছি না। আমার বিষয় অন্য। আমার সহনাগরিক বন্ধু রমলাকান্ত যখন বললেন, আমার আপনার দেশের বিপুলভাবে জিতে আসা সরকার বজরং দলের নয়। নয় কোনও পরদেশী ভাবধারায় আধারিত কমিউনিস্ট দলের। এ’ হ’ল সম্পূর্ণ ভারতীয় ভাবধারার বহুজাতিক, বহুভাষিক ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার, তখন সহনাগরিক বন্ধু কথিত এই ভারতীয় ভাবধারাটির দিকে আমি কিঞ্চিৎ মনোযোগ দিই। আসলে ভাব এমনই একটি ব্যাপার যে সত্যিই তার ধারাটি খুঁজে বের করা বড়োই মুশকিল আমার মতো নিতান্ত আনাড়ির পক্ষে। বিষয়টা কিন্তু পরদেশী ভাবধারায় আধারিত কমিউনিস্ট দলের কথাটি নিয়ে নয়। শল্যচিকিৎসা থেকে টেলিফোন, এর’ম পরদেশী অনেক আছেবিষয়টা লুকিয়ে আছে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ওই আশ্চর্য বইটিতে। এই যে বৈদিক ধর্ম, সোজা বাঙলায় যা হিন্দু ধর্ম, বা আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তা যে কতপ্রকারে অনার্য ধর্ম থেকে এমনকি ইসলাম থেকেও নিয়ে নিজেকে পুষ্ট করেছে, ঠিক যেভাবে সমাজ ও প্রকৃতি বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেই ভারতীয় ভাবধারাটিকেই কত বছর আগে কি জরুরি এবং সহজ ভঙ্গিতে লিখেছিলেন বইটিতে। এই ধর্মের পরতে পরতে কত জায়গায় যে সেই নরম আদরের দাগ লেগে, তা রাজনীতির নিয়মে জানতে দেওয়া যায় না, বুঝতে দেওয়া যায় না মানুষকে। আর ‘একটা’ ধর্মই তো শুধু নয়, ভারতীয়, বহির্ভারতীয়, কৌম লোকায়তর সাথে কত শ্রেণি, কত স্তর, কত দেশখণ্ডের মানুষের ধর্ম যে এই চলমান আর্য-ব্রাহ্মণ্য স্রোতে তাদের স্রোত মিশিয়েছে, তার কি শেষ আছে? সেজন্যেই বৈষ্ণব ধর্মে তন্ত্রের প্রভাব। সেজন্যেই জাহাঙ্গীরের পোশাকে ড্রাগন চিত্র। সেজন্যেই উপনিষদের ফারসি অনুবাদের সম্পাদনা করেন শাজাহান-পুত্র দারা শুকোএ দেশের বিভিন্ন জনপদগুলির, লোকায়ত অনার্য আদি অধিবাসীদের পুজো, তাদের আচার, দেবদেবী, অনুষ্ঠান, ভয়, বিশ্বাস, সংস্কার সেই আদিমতম কৃষি ও গ্রামীণ সমাজের শিল্প-সুষমাময় কত ধানের ছড়া, কত আলপনা, কত পান-সুপুরি আর কলা বৌ হয়ে, কত শ্মশান-কালী, ভৈরব, মাশান হয়ে, কত চড়ক, ষষ্ঠী, মনসা, নবান্ন হয়ে তোমার আজকের এত গর্বের আর্য-ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মকে শ্বাসবায়ু দিয়ে ঋদ্ধ করেছে; যখন তুমি গর্বের সাথে নিজেকে হিন্দু বলো, তখন এই সমণ্বয় আর প্রাচীন আদিবাসী সংস্কার ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক দানকে কি স্বীকার করো তুমি? আজ বড্ড প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় উনি অতদিন আগে কীভাবে টের পেলেন জানি না। আরও একটা বিষয়, ভদ্র বাঙালি হিন্দুর এই যে আজ তন্ত্র-মন্ত্র-যজ্ঞ-স্নান আর সারা দেশজুড়ে গেরুয়া রঙের হিন্দুধর্ম, এর মূল ভিত্তিই হয়েছিল সেন যুগে। মানে ১০৯৭ থেকে ১২২৫ খ্রীষ্টাব্দ, এই একশ’ আঠাশ বছরে। আর এই যে আচার-সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় প্রচলন, সে যুগে এর কারণ যে রাজনৈতিক ছিল, তা বলাই বাহুল্য। বেদ বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাজশক্তির বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্য, মূল কারণ ছিল এটাইফলে এই আচার সর্বস্ব হিন্দু প্রথাগুলির প্রচলন, পৃষ্ঠপোষকতা এবং রমরমা সে যুগ থেকেই শুরু। এদেশে ধর্ম ও সংস্কৃতির যে সমন্বিত চিরায়ত রূপ, এগুলো সেই সংস্কৃতি কথা নয়

ভাষ্যকার (একমাত্র জীবিত চরিত্র)
ধরা যাক, দিনের কোনও এক সময়ে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ, তার জানা সমস্ত শব্দের ‘মানে’ (অর্থ) ভুলে গেল—চিহ্ন ও চিহ্নিত বস্তুর মধ্যে যে সম্পর্কের সুতো, যাকে বেঁধেছে মানুষের সামাজিক বোঝাপড়া, সেটাই কেটে গেল—শব্দগুলো, চিহ্নগুলো রইল সবই—শুধু তাদের গায়ে যে স্মৃতি চাপিয়েছিল মানুষ, রেফারেন্সের বা চিহ্নিত বস্তুর যে বোঝা চড়িয়েছিল, তা খসে গেছে। তাদের কোন্‌টার যে কোন্‌ মানে হয়, কোন্‌ শব্দ যে কোন্‌ বস্তু বা অবস্থাকে চিহ্নিত করে—সবাই ভুলে গেছে। ‘ব্রজ’ আজ আর মথুরাসমীপস্থ কোনও গোকুলধাম নয়, ‘তৃণ’ আজ ঘাস নয়। খড় নয়। শুধু শব্দ মাত্র। কোনও ফরাসির কাছে ‘লে’ আর নয় বিছানা, সংস্কৃতে ‘অশ্ব’ আর কোনও ঘোড়াকে চিহ্নিত করে না। যেন বহুকালের জরাজীর্ণ এক পোড়ো বাড়ি—তার গায়ে গায়ে ঝুল, মাকড়সা, ইঁটের মাড়ি আর নানা গাছের ডাল, পাতা—বাড়ির লোকজন সব বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে হাওয়া—পড়ে আছে শুধু বাড়িটা—পড়ে আছে শুধু শব্দ, চিহ্ন—পড়ে আছে ক্যালেন্ডারের তারিখটা—মানুষগুলো আর সেখানে নেই, ঘটনা আর সেখানে থাকে না, চিহ্ন প’ড়ে আছে একা, চিহ্নিত বস্তু তাকে ফেলে কোথায় চলে গেছে। বঙ্কিমের কথাগুলো যেন চিহ্নিতকরণের সেই স্মৃতি থেকেই বিচ্যুত করল ইতিহাসকে। ইতিহাসের কালপঞ্জী দাঁড়িয়ে রইল একা। তার ঘটনা চলে গেল তাকে ছাড়িয়ে।    

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
আমাদের কারও আর কোনও ব্যক্তিগত অতীত নেই, সমষ্টিগত ইতিহাস আছে। অতীত, কুয়োর জলে প’ড়ে যাওয়া এক ইঁদুর। কুয়োর গোলাকার পাঁচিলে যে চক্রাকারে বন্‌বন্‌ ঘুরেই চলেছে। ইতিহাস, প্রসারণশীল। অতীতের রয়েছে রিজিডিটি। ইতিহাসের ইলাস্টিসিটি। ব্যক্তির অতীত হয়। পরিবারের, শহরের, দেশের, সভ্যতার, ভাষার, সংস্কৃতির হয় ইতিহাস। অতীত অনেকটাই দূরের বাসজার্নি। পাশাপাশি সব সীটেই বসে আছে লোকজন, তবু কারও সাথে কোনও কথা নেই। আলাপ নেই। কোথাও বাস থামলে চা-বিস্কুট-সিগারেট ভাগ ক’রে নেয়া নেই সহযাত্রীর সাথে। সবাই চলেছে, একসাথে, এবং আলাদা। ইতিহাস, আমার না হয়েও আমার। আমার হয়েও আমার নয়। যেমন ট্রেনজার্নি। এক-কামরার সবাই যেন এক যৌথযাত্রায়টিফিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে উলটো দিকের সীটে। কত-কতবার ঠিকানা-ফোন নাম্বারও দেয়া-নেয়া হচ্ছে। চৈতন্যের (নিমাই নয়) তো একটা ঐতিহাসিক রুট রয়েছে, নাকি।     
ইতিহাস আবার অনেক রকম। কে কী লিখছে, কাদের কথা লিখছে, কিভাবে লিখছে, কোথা থেকে নিচ্ছে উপাদান ও উৎস—এসবের ওপর নির্ভর ক’রে তার রকমভেদ। কতবার ভেবেছি, একটা দেশ না হোক, একটা শহরের কি গ্রামের না-হোক একটা ছোট্ট পাড়ারই ইতিহাস যদি আমি লিখি, যেখানে ঐতিহাসিকের সন-তারিখের শুকনো ছাল নয়, ইতিহাস হবে মানুষের মুখের কথা। কোন সালে সেখানে ইস্কুল তৈরি হয়েছে, কোন সালে লাইব্রেরি, কোন সালে বন্যা হল, কোন সালে খরায় শুকিয়ে গেল পশ্চিম পাড়া—সেসব নয়। সারা পাড়ার সব লোকের মুখের গল্প নিয়ে, সেই পাড়াটা নিয়ে যার যে গল্প জানা আছে, যে যা শুনেছে তার দাদুর কাছে, জ্যাঠার কাছে, কোনও বোষ্টমী ভিকিরির কাছে, কি কোন্‌ কালে পড়েছে কোন্‌ স্কুল ম্যাগাজিনে, কি যা সে ছেলেবেলা থেকে মনে-মনে ভেবেছে, কল্পনা করেছে, যা কিছু গুজবে রটেছে, লোকের মুখ থেকে মুখে যেতে যেতে যে কথা পালটে পালটে গেছে কতবার—লোকেদের মুখের সেইসব কথা দিয়ে লিখি যদি একটা পাড়ারই ইতিহাস।     

রমলাকান্ত বলে ওঠেন,—‘আজ্ঞে, শুনতে তো বেশ মনোরমতা আপনার এই জানাটি কোন্‌ ফরেনারের বই থেকে বঙ্কিম? আমাদের এই আচার-অনুষ্ঠানগুলা এগুলো কী জানেন? এগুলো কৃষি সভ্যতার অনুষ্ঠান। অধিকাংশই দ্রাবিড়ীয়। এতে বেদ বিরোধিতাই বলুন বা আনুগত্য, কোথায়? ঠিক কোন্‌ জায়গাটায়? ট্টু বোঝাবেন?’  
মধুসূদন বুঁদ হয়ে শুনছিল। রাতের আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে কালীপ্রসন্ন আর শরৎচন্দ্র হাত ধরাধরি ক’রে হাঁটছে। অন্ধকার আর ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চ’লে যাচ্ছে ওদের পাশ দিয়ে। ওদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যদিও, সে বড়ো মৃদু। শুধু আলো আঁধারিতে আবছা বোঝা যাচ্ছে হাত নাড়া আর ভেজা ঘাসে হেঁটে যাওয়ার শব্দ, ধীরদূরে, ক্রমশ কালীপ্রসন্ন আর শরৎচন্দ্র মিলিয়ে যায়। হালকা গুনগুন গলার স্বর ভেসে আসে। একসময় তা-ও হারিয়ে যায়। প’ড়ে থাকে একরাশ হিম আর কুয়াশা। অন্ধকার পরিচালনা করে এই রাতরাত নয়, অন্ধকারই, রাজা, এখানে। মধুসূদন মাথা নীচু করেই জড়ানো গলায় প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে এই আচারগুলো ঠিক কোন্‌ সময়ে বাঙালি হিন্দুর জীবনে আচার হিসেবে প্রবেশ করল ব’লে মনে হয় বঙ্কিম?’  

‘আজিকার দিনে কিংবা আদি ও মধ্যযুগে ‘ভদ্র’, উচ্চস্তরের বাঙালী জীবনে যে ধর্মকর্মানুষ্ঠানের প্রচলন আমরা দেখি ও যাহাকে বাঙালীর ধর্মকর্ম জীবনের বিশিষ্টতম ও প্রধানতম রূপ বলিয়া জানি, অর্থাৎ বিষ্ণু, শিব, সূর্য, গণেশ, অসংখ্য বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ও তান্ত্রিক বিচিত্র দেবদেবী লইয়া আমাদের যে ধর্মকর্মের জীবন তাহা একান্তই আর্য-ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন-তান্ত্রিক ধর্মকর্মের চন্দানুলেপনমাত্র এবং তাহা, সংস্কৃতির গভীরতা ও ব্যাপকতার দিক হইতে, একান্তই মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে ধর্মকর্মময় সাংস্কৃতিক জীবন বাঙালীর জীবনের গভীরে বিস্তৃত, যে-জীবন নগরের সীমা অতিক্রম করিয়া গ্রামে কুটিরের কোণে, চাষীর মাঠে, নদীর পাড়ে বটের ছায়ায়, জনহীন শ্মশানে অন্ধকার অরণ্যে, নৃত্য-গীত-সংগীত-পূজা-আরাধনার বিচিত্র আনন্দে, দুঃখ-শোক-মৃত্যুর বিচিত্র লীলায় বিস্তৃত, সেই ধর্মকর্মময় সংস্কৃতি আর্য-মনের, আর্য-ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন-তান্ত্রিক ধর্মকর্মের সাধনা ও অনুষ্ঠানের নীচে চাপা পড়িয়া আছে। এই চাপা পড়ার ফলে কোথাও কোথাও তাহা জীবনের কন্ঠ ও নিশ্বাসরোধে একেবারে মরিয়া গিয়াছে, তাহার নিষ্প্রাণ কঙ্কাল শুধু বর্তমান; কোথাও কোথাও উপরের স্তরের চক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করিয়া এখনও বাঁচিয়া আছে—নিশীথ অন্ধকারে লোকালয় অতিক্রম করিয়া ভয়কম্পিত হৃদয়ে সুদীর্ঘ সঙ্কটময় পথ ধরিয়া নদীর ধারে বা প্রান্তরের সীমান্তে শ্মশানের ধারে গিয়া লোকালয়েরই লোক সেই সংস্কৃতির পাদমূলে একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া তেমনই নিভৃতে গোপনে ফিরিয়া আসে। ...এই রুদ্ধ ও মৃত, মরণোন্মুখ অথবা চলমান ধর্মকর্ম স্রোতের সকল চিহ্ন তুলিয়া ধরিবার উপায় এখানে নাই।’    
বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, ধর্মকর্ম : ধ্যান-ধারণা, আর্যপূর্ব ও আর্যেতর ধর্ম, পৃঃ ৪৮০; নীহাররঞ্জন রায়   

বঙ্কিমচন্দ্র থালা থেকে একটুকরো হাঁসের মাংস তুলে নেনখালি হয়ে যাওয়া গ্লাসটা এগিয়ে দেন রমলাকান্তর দিকে। মধুসূদন নিজের বোতল থেকে মদ ঢেলে দেন তাতে। মদে চুমুক দিয়ে বঙ্কিম বলেন,—‘একমাত্র পাল যুগেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম দু’জনেই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। দু’জনেই সমানভাবে চলেছে। সমান স্বীকৃতি পেয়েছে। পাল রাজারা প্রত্যেকেই মহাযানী বৌদ্ধ। কিন্তু এ’ বংশের বেশিরভাগ রাজাই বিয়ে করেছে হিন্দু বংশের মেয়েকে। ফলে সেই সময়ে আচার সর্বস্ব হিন্দু প্রথার বাড়াবাড়ির সম্ভাবনা নেই। আমার আরও একটা পয়েন্ট আছে। হিন্দু ধর্ম বলতে যা বোঝায়, তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান তার মধ্যে প্রধানঅন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির একান্ত অনুরক্ত গোঁড়া সেন রাজাদের অনুপ্রেরণায় বাঙলার ও বাঙালির ধর্মীয় জীবন যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বেদ পুরাণ শ্রুতি স্মৃতি জ্যোতিষের সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়েছিল এ’ তো তোমার অজানা নয় মাইকেল। পাল যুগের পরবর্তী দেড়শ’ বছরের ইতিহাস তো বেদ পুরাণ শ্রুতি স্মৃতি নির্ভর ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই ইতিহাসরমলাকান্ত যেটা বললেন, দ্রাবিড়ীয় বা দাক্ষিণাত্য, সেটা একটা ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট। সেন যুগের যে মূর্তিগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে একটা লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগল মূর্তি। খুব সম্ভবত এটাও দাক্ষিণাত্য থেকেই পেয়েছিল সেনরা। তেমনিই দ্রাবিড়ীয় কৃষিসভ্যতার এই আচারগুলো সেনরাজারা অ্যাডপ্ট ক’রে থাকতেই পারেন। কেননা পাল রাজাদের মতো দাক্ষিণাত্য ক্ষৌণীন্দ্র সেনরাজারা তো এ’ বাঙলার অর্থাৎ বঙ্গজ নন। আদিনিবাস মহীশূর। কিন্তু রাষ্ট্রের উৎসাহ ও নির্দেশে এই যে হাজার বছরের লোকায়ত অনার্য সমন্বয়কে অস্বীকার ক’রে আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদের সক্রিয় প্রসারণ, সেনরাজাদের আগে এটা ছিল না। আর বল্লাল সেনের বৌদ্ধ বিদ্বেষ তো দানসাগরে বিখ্যাত।’



‘‘বৌদ্ধধরর্ম্মে চারিটি প্রধান দার্শনিক মত বা ‘বাদ’ প্রচলিত আছে। যথা—বৈভাষিক, সৌত্রান্তিক, যোগাচার ও মাধ্যমিক। বৈভাষিকদিগের প্রধান গ্রন্থ কাত্যায়নী পুত্র লিখিত ‘জ্ঞান-প্রস্থান’। এই শাস্ত্রের ছয় অঙ্গ। এতদ্ব্যতীত বসুবন্ধুর অভিধর্ম্মকোষের উত্তরে লিখিত সঙ্ঘভদ্রের ন্যায়ানুসারে গ্রন্থও ইহাদের শাস্ত্রের অন্তর্গত। সৌত্রান্তিকীদিগের প্রধান গ্রন্থ আচার্য্য বসুবন্ধু রচিত ‘অভিধর্ম্মকোষ’। বৈভাষিক দর্শনের পরিচয় চীন ভাষায় এবং চৈনিক লিপিতে মাত্র পাওয়া যায়। বসুবন্ধুর অভিধর্ম্মকোষ কয়েকখানি টীকা ও ভাষ্যসহ ভোট ভাষায় বর্ত্তমান। যোগাচারিগণ বিজ্ঞানবাদী ও মাধ্যমিক শূন্যবাদী, যোগাচারের প্রধান আচার্য্য অসঙ্গ। তিনি বসুবন্ধুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা; অসঙ্গ পেশওয়ার নগরে জন্মগ্রহণ করেন। শূন্যবাদের প্রধান আচার্য্য নাগার্জ্জুন। এই দুই মত মহাযানের অন্তর্ভুক্ত। চীন জাপানের বৌদ্ধরা বিজ্ঞানবাদী ও ভোটীয়েরা শূন্যবাদী; শূন্যবাদ বজ্রযানের সহায়ক।’’ 
নিষিদ্ধ দেশে সওয়া বৎসর, উদ্যোগ পর্ব, পৃঃ ১২৪-২৫; রাহুল সাংকৃত্যায়ন     

‘পাল-চন্দ্ররাষ্ট্রে ও তাঁহাদের কালে ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-বিন্যাসের আদর্শ ছিল উদার ও নমনীয়; কম্বোজ-সেন-বর্মণ আমলে সেন-বর্মণ রাষ্ট্রের সক্রিয় সচেতন চেষ্টার ফলে সেই আদর্শ হইল সুদৃঢ়, অনমনীয় ও সুনির্দিষ্ট। যে বর্ণবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থা আজও বাঙলাদেশে প্রচলিত ও স্বীকৃত তাহার ভিত্তি স্থাপিত হইল এই যুগে দেড় শতাব্দীর মধ্যে। বাঙলার সমাজ-ব্যবস্থার এই বিবর্তন প্রায় হাজার বৎসরের বাঙলাদেশকে ভাঙিয়া নূতন করিয়া ঢালিয়া সাজাইয়াছে।... দেখিতে দেখিতে বাঙলা দেশ যাগ-যজ্ঞ-হোম ক্রিয়ার ধূমে ছাইয়া গেল, নদ-নদীর ঘাটগুলি বিচিত্র পুণ্যস্নানার্থীর মন্ত্র-গুঞ্জরণে মুখরিত হইয়া উঠিল, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ব্রতানুষ্ঠান দ্রুত প্রসারিত হইল। সহজ স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয় নাই; পশ্চাতে ছিল রাষ্ট্রের ও রাজবংশের সক্রিয় উৎসাহ, অমোঘ ও সচেতন নির্দেশএই যুগের লিপিমালা, অসংখ্য পুরাণ, স্মৃতি, ব্যবহার ও জ্যোতিষগ্রন্থ ইত্যাদিই তাহার প্রমাণ।’  
বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, সেন-বর্মণ যুগ : বর্ণ-বিন্যাসের চতুর্থ পর্ব, পৃঃ ২৩৫; নীহাররঞ্জন রায়   



এত কথার মাঝখানে শরৎচন্দ্র কখন এসে ব’সে পড়েছেন। কালীপ্রসন্নকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। বঙ্কিমের কথা শেষ না হতেই শরৎচন্দ্র বলেন, এস ব্রত, আচার বহু আগে থেকেই বাঙলায় চালু জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থ দেখুন।’
নীহাররঞ্জনের’, কৃন্তক দাঁতে মাংসের একটা সুবৃহৎ টুকরো কেটে জিভে ও দাঁতে ব্যালেন্স করতে করতে রমলাকান্ত বলেন বাঙালির ইতিহাসটাও দেখুন’।   
বঙ্কিম বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে। সেনযুগের সময়কালটা দেখুন। ১০৯৭ থেকে ১২২৫ খ্রীষ্টাব্দআবার জীমূতবাহনের সময়কালও দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী। অর্থাৎ সেনযুগেই এসবের প্রবর্তন
রমলাকান্ত মাংসটাকে দাঁতে পিষে অনেকটা মিহি ক’রে এনেছেন। অনেকক্ষণ পড়া বুঝিয়েও ছাত্র না বুঝলে গৃহশিক্ষক যেমন রাগগুলোকে দাঁতে লেই করতে করতে কথা বলেন, মাংসের শেষ অংশগুলো চোয়ালের দু’পাশের দাঁতে সেভাবেই আরও মিহি করতে করতে রমলাকান্ত বললেন, আরে, পাল যুগেবৌদ্ধচর্চা—আর প্রভাবের প্রকৃতিএবং সে সময়ে গ্রামীণ বাঙালিদেরধর্মীয় জীবনেরফারাকটা দেখবেন না? আর ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের সাথে বাঙালি হিন্দু লোকাচারের যে ফারাক তাও আপনার চোখ এড়িয়ে গেল! কিছু মানুষ বাদ দিলে বাঙালিরা হিন্দু বৌদ্ধ এসব কিসুই ছিল নাছিল টোটেম পূজারী। ফলত প্রবর্তন কথাটি ভুল। স্বীকার করুন। প্রথাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলো অনেক আগের সময় থেকেই বাঙলায় ও বাঙালি জীবনে চলে আসছে।’   

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
আচ্ছা, ঔপন্যাসিকের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমরা কি তার জায়গা দখল করছি? আমরা তো একটা মজবুত পরিকল্পনা নিয়ে এখানে এসেছি। যেভাবে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রের সংসদে। পূর্ব-পরিকল্পিত। নির্মিত। ফ্যাব্রিকেটিং। এবং উপন্যাস। শুধু পার্থক্য একটাই, সেই সন্ত্রাসবাদীর আগ্নেয়াস্ত্র থেকে বুলেট বেরুচ্ছে না। এন্‌ নান্‌না, আনন্দে নেচে নেওয়ার মতো কিছু নয়। গোলাপের পাপড়িও বেরুচ্ছে না। বন্দুকের নল থেকে ছর্‌রা হয়ে বেরুচ্ছে গোটা দেশের হাজার হাজার পঞ্চায়েত, মৌজা, ব্লক, গ্রাম, গঞ্জ, মহকুমা, হাট, অঙ্গনওয়াড়ি, শহর, বস্তি, উদ্বাস্তু কলোনি, জঙ্গল, পাহাড়, গুম্ফা, নদীচর, শরণার্থী শিবির, ফুটপাত, অস্ত্রাগার, বেশ্যাপাড়া জুড়ে থাকা কোটি কোটি... [অসমাপ্ত বাক্যটি সম্পূর্ণ করুন]

বঙ্কিম তাও হাল ছাড়েন না। মরিয়া হয়ে বলেন, ‘দেখুন, আমি একটা অন্য দিক থেকে দেখি। হিন্দু পুজোয় আসন, মুদ্রা, মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র এগুলো দেখা যায়। এগুলো সেদিনও ছিল। এবং এগুলো সবই তন্ত্র পূজার আঙ্গিক। এই তন্ত্র সাধনা আর্য তথা বৈদিক যুগেরও প্রাচীন। পৌরাণিক তান্ত্রিক ধর্মই সে সময়ে বাঙালি হিন্দুর মূল ধর্ম। গুপ্ত সম্রাটদের সময়ে বৈদিক পৌরাণিক, বৈষ্ণব, শৈব এই ধর্মগুলো যেমন বিকাশ পেয়েছে, তার সাথে অবৈদিক বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মও কিন্তু বাধা পায়নি। গুপ্ত সম্রাটরা বৈষ্ণব হলেও বৌদ্ধবিহারের জন্য ভূমি দান করেছে। ফা-হিয়েন এবং হিউয়েন সাং-এর বিবরণও গুরুত্বপূর্ণ এখানে। এই সাপোর্টিং প্রমাণগুলোই কি ব’লে দেয় না যে, গুপ্তযুগে ধর্ম বিশ্বাসে স্বাধীনতা দান এবং পরমত সহিষ্ণুতাটা ছিল। আচার সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়বাড়ন্ত হয়নি। চীনা পর্যটকদের যা বিবরণ, তাতে গুপ্তযুগে বৌদ্ধধর্মের প্রসার একেবারে মন্দ না। পাল যুগে এসে এর প্রসার আরও বেশি। বৈদিক ধর্ম প্রচারের জন্য যতটা জোর দিয়েছিলেন গুপ্ত ও সেনরা, পালরা তা-ও দেননি। পাল যুগে গ্রামীণ বাঙলার মানুষ বৌদ্ধধর্মের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছেএবং তা গ্রহণ করেছে। পাল যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সমণ্বয়ের চেষ্টাও খুব স্পষ্টতাহলে রইল প’ড়ে সেন। মানে ওই ১১শ’-১৩শ’ শতাব্দী।’

‘‘গুপ্ত-সম্রাটগণের মধ্যে সমুদ্রগুপ্তের যে স্থান, পালবংশে ধর্ম্মপালের নাম ও পদমর্য্যাদা তদ্রূপ ছিল। গঙ্গাতটে এক সুন্দর ছোট পাহাড় দেখিয়া মহারাজ ধর্ম্মপাল সেখানে বিক্রমশিলা বিহার স্থাপন করেন। এই পরাক্রান্ত নৃপতির কৃপাদৃষ্টি থাকায় এই বিহার অল্পদিনেই বিশালরূপ ধারণ করে। নালন্দার ন্যায় ইহাকে বহুকালব্যাপী ক্রমোন্নতিসোপান অতিক্রম করিতে হয় নাই। এখানে অষ্ট মহাপণ্ডিত ও একশত আট পণ্ডিত এবং বহু দেশী-বিদেশী বিদ্যার্থী থাকিত। ...বিহারের ভিতরে অবলোকিতেশ্বরের মন্দির ও পরিক্রমায় ছোট বড় ৫৩টি তান্ত্রিক দেবালয় ছিল।...সেই ঘোর তান্ত্রিক যুগে ইহা তন্ত্রমন্ত্রের বিরাট দুর্গবিশেষ ছিল। চুরাশী সিদ্ধের প্রায় সকলেই পালবংশের রাজত্বকালে উদ্ভূত এবং ইহাদের অধিকাংশই বিক্রমশিলা বিহারের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন।’’   
নিষিদ্ধ দেশে সওয়া বৎসর, উদ্যোগ পর্ব, পৃঃ ১২৭-২৮; রাহুল সাংকৃত্যায়ন    

আমরা দেখতে পাচ্ছি এই বিতর্ককে শুরু থেকে প্রধানত চালিয়ে নিয়ে গেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। রমলাকান্ত চেষ্টা করেও তাঁকে কাবু করতে পারেননি। কিন্তু এখানে শেষ হুল ফোটান মাইকেল। তাঁর তিনটি যুক্তির সামনে বঙ্কিমও কার্যত স্তম্ভিত হয়ে যান। বিতর্কের যাবতীয় রাশ নিজের হাতে টেনে মাইকেল বলেন, ‘বঙ্কিম, টুয়েলভ হান্ড্রেড টুয়েন্টি ফাইভ মাইনাস ওয়ান থাউজেন্ড নাইন্টি সেভন্‌, মানে, হান্ড্রেড টুয়েন্টি এইট? তাইতো? একশো আঠাশ? একশো আঠাশ বছরে এতসব অনুষ্ঠান প্রবর্তন করলে লোকজন এর খরচের ধাক্কা নিতে পারবে? রাজা আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে উপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের এনে যজ্ঞ করান ৭৩৬ খ্রীষ্টাব্দেঅর্থাৎ পাল যুগ শুরুর চোদ্দ বছর আগে। উত্তরভারতের কিছু ধর্মাচার সে সময়েই আসার কথাযেমন সূর্যের আপাত গতি সম্পর্কিত যে চারটি অনুষ্ঠান, দোলযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা, এই চারটি আদিম কৃষি সভ্যতার অনুষ্ঠান হলেও এগুলির উত্থান কিন্তু বৈষ্ণবীয় ভক্তি আন্দোলনের সময়। অনেকেই মনে করেন হোলি শব্দটা সংস্কৃত হল্লীসক্রীড়ম্‌ থেকে এসেছে। তবে এটা একেবারেই ঠিক, যেটা মহেন্দ্র দত্ত ওঁর বইতে বলেছিল, পুরাণ তৈরি করতে বেশি পরিশ্রম লাগে না। একটা গল্প খাড়া ক’রে দিলেই হল আর প্রথম পাতায় লিখে দাও স্বয়ং ব্যাস এসে বলেছে। এইভাবে অনেক পুরাণ তৈরি হয়েছে ও হবে। কল-কারখানা তৈরি না হোক, পুরাণ কারখানা অনেকগুলো তৈরি হয়ে গেছে।   

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
ফলতঃ, বোঝাই যাচ্ছে কথাটা কারও একার নয়। কথাটা এর। ওর। তার। এরকম অবস্থায় নিজের একার কথা বলেও থাকতে পারে না কিছু। যদি আমি ওই আগ্নেয়াস্ত্রের নল নির্গত কোটি কোটি কথার মধ্যে নিজের কথাকেও রাখতে চাই, তাহলে আমার কথাও দেশের একটা কথা হতে পারে। হয়ে উঠতে পারে। আজ। আর যদি ভাবি, না, মঞ্চে আসীন প্রধানতম মন্ত্রীর বুড়ো আঙুল চেটে তকতকে ক’রে দেব বলেই আমি এসেছি এখানে, তাহলে আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শুনতে হবে কোটি কোটি লালানিঃসৃত অবিশ্বাসবলা বাহুল্য শেকলকাটা আর্তনাদও। অবশ্য, কান ব’লে যদি তখনও কিছু কানের যোগ্যতায় থাকে।   

বঙ্কিম চুপ ক’রে থাকেন অনেকক্ষণ। বাকিরাও কেউ কথা বলেন না। ঘাসের ওপর শিশির পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। আসলে, এক-একটা দিন, এক-একটা তারিখ হচ্ছে এক-একটা বারকোশ। বা কটোরা। ঠঙ্‌ ক’রে কখন তারিখের কটোরায় একটা ঘটনা পড়বে, তারিখ ব’সে আছেকোনও এক দিনে প্রচুর ঘটনা ঘটে গেলে, তখন তা কটোরা উপচে বাইরে ছলকে পড়তেই পারে। বাইরে অতীত এবং ভবিষ্যতের তারিখ নিয়ে যেসব কটোরা থরে-থরে রাখা, তার মধ্যে গিয়েও পড়তে পারে। আবার, একটা তারিখের সাথে আরেকটা তারিখের মধ্যে যে নো-ডেট-লাইন নামক শূন্য ও ফাঁপা সময় থাকে, তার মধ্যেও পড়ে কিছুটা। এই নো-ডেট-লাইন এক মাধ্যাকর্ষণহীন এলাকা। এখানে কোনও বস্তু এসে পড়লে তা স্পেসে ঘুরতে থাকা বস্তুর মতো ভেসে থাকে। তার নিয়তি ছাড়া আর কেউ তাকে তখন আকর্ষণ করে না। বাঙলার সাহিত্য কিংবা সমাজবিজ্ঞানের পাতায় এই বিতর্ক কোনওদিনই জায়গা পাবে না জেনেও দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অনমনীয় গলায় বঙ্কিম বলেন, যদিও মধুসূদনকে উদ্দেশ্য করেই বলা, তবু কেন যেন মনে হয় গোটা দেশটাকেই তিনি এ’ কথা বলছেন, আমার বিষয় ইতিহাস নয় মধুসূদন। আমি শুধু বাঙলার ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্বকে দেখাতে চেয়েছি। যে সময়ে এমন একটা শক্তি এ’ দেশে ক্ষমতায় এসেছিল, যাদের কীর্তির কু প্রভাব ভদ্র হিন্দু বাঙালি আজও বয়ে চলেছে। আজ যারা বিপুলভাবে জিতে দেশের ক্ষমতায় এসেছে, এই ক্ষমতাসীন দল সেই যুগেরই এক বিরাটাকায় ছায়া। আজ তাদের হাতে ক্ষমতা আরও বেশি। তার সূঁচ আজ আরও বেশি তীক্ষ্ণ। ক্ষতর গভীরতা, ব্যাপ্তি ও তার রক্তপাতও আজ অনেক বেশি। আমার বিষয় ইতিহাস নয়। আমার বিষয় মানুষ। হয়ত মানুষও নয়। মানুষের শোক ও রক্ত। ক্যালেন্ডারের তারিখ উপচে যা এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সায়েন্স ফিকশন যেমন বিজ্ঞানেরই একটা অংশ, আমরাও তেমনি হিস্টোরিকাল ফিকশনের এক-এক জন। যা অতীত এবং ভবিষ্যতের ইতিহাস। বর্তমানেরও।’   

কমলকুমার মজুমদার
মাধব, আমাতে যিনি আনন্দ, জয় যুক্ত হউন, জয় তারা ব্রহ্মময়ী জয় রামকৃষ্ণ   
অর্থাৎ, পক্ষ লইতে হইবে। ইহা সেই সময়, যখন, কী হইবে আমার কথা, শুধু এইটুকু ঠিক করিলেই আর চলে না। সে কথা কোথায় রাখা হইবে? কোথায় দাঁড়াইবে? সে কি এই ছুটন্ত কথাস্রাবের অংশ লইবে না? না-কি শহরের প্রবেশপথে ফুলের তোড়া লইয়া দাঁড়াইবে নতশিরপক্ষ লইতে হইবে। দুগ্ধ, তণ্ডুল, কদলী, সাগু, চিপিটক ও শর্করা মিশিয়া যে মণ্ড তৈরি হয় তাহাতে ইন্ডিভিজুয়াল ইনগ্রেডিয়েন্টগুলার পৃথক দাবী আর টেকে না। ওই ছয়টি উপাদান মিশিয়া এমন একটি সপ্তম দ্রব্য নির্মিত হইয়াছে যাহা একা দুগ্ধে একা শর্করাতে ছিল না। তাম্বুল হরিদ্বর্ণ, চুন শ্বেতদুয়ে মিশিয়া লাল বর্ণের নিষ্ঠীবন নির্মাণ করে। সকলের আলাদা-আলাদা কথা হইল সেই দুগ্ধ, তণ্ডুল, কদলী, সাগু, চিপিটক ও শর্করাপ্রত্যেকের ফ্যামিলি আলাদা। সব কথা মিশিয়া এমন একটা কথা তৈরি হইল যাহা ওই মিশ্রণের পূর্বে ছিল না। ভয়, লজ্জা, সাহস, শোক ও আনন্দ—এই পঞ্চানুভূতি আমরা কোন্‌ ইন্দ্রিয় দিয়া গ্রহণ করি? কোন্‌ ইন্দ্রিয় মারফৎ অপরকে দিই এইসব? প্রত্যেকটা মানুষ যদি যথাক্রমে এই পঞ্চানুভূতিতে যুগপৎ ঘাতক ও শহীদ হইতে চায় প্রমাণ হইবে ‘সৈন্যে শস্ত্র ছুঁড়ছে তা নয়, কোষ থেকে আপনি ছোটে’।    

রাত আরও বাড়লে, মাঠের শেষ কিনারায়, রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন বঙ্কিম। রাতের কুয়াশায় লেগে চাঁদের আলো ধোঁয়ার মতো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে এটা বললে খুব ক্লিশে বলা হয়, তবুও, এটাই সত্যিবঙ্কিমের সিগারেট থেকে বেরুনো ধোঁয়াও কি অনাবিল মিশে যায় তাতে। কোনও ঐতিহাসিক নেই, কোনও সীমান্তরক্ষী নেই যে এই কুয়াশা, চাঁদের আলো আর ধোঁয়ার সীমানা আঁকবে। বেশ অনেকটা দূর থেকে শোনা যায় রমলাকান্তের জড়ানো গলা, ‘হেঃ, সারা সন্ধে ইতিহাস নিয়ে বকরবকর ক’রে গেলে—আর শেষে এসে বলছ, কী, না আমার বিষয় ইতিহাস নয়। হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ। দেশের ইতিহাস কি তোমার নভেল নাকি বাবা!’ বঙ্কিম আপাত নিশ্চল চাঁদের দিকে তাকিয়েই থাকেন। মনে মনে কিছু, হয়ত বলেন। কিছু একটা উত্তর তো সাজাচ্ছেন নিশ্চই।
—‘আসল সময়ে আসল কথাটা বলতে পারেন না কিছুতেই।’
—‘যখন মনে পড়ে, তখন হাতের সামনে থেকে খাতা সেখানে চলে গেছে যেখান থেকে তার আর ফেরা যায় না।’  
—‘আমরা যে এত কথা বলি, এত কথা, মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে যাবার পর সে যায় কোথায়?’
—‘আমরা শহরের ‘বুকে’ দাঁড়াই, গ্রামের ‘প্রান্তে’ দাঁড়াই, নদীর ‘তীরে’ দাঁড়াই, আলোর ‘নিচে’ দাঁড়াই, বন্ধুর ‘পাশে’ দাঁড়াই, ঝোপের ‘আড়ালে’ দাঁড়াই, ক্ষমতার ‘কেন্দ্রে’ দাঁড়াই, নেতার ‘পেছনে’ দাঁড়াই, খেলার ‘মাঠে’ দাঁড়াই, ভোটের ‘টিকিটে’ দাঁড়াই, জাহাজের ‘ডেকে’ দাঁড়াই, মিছিলের ‘সামনে’ দাঁড়াই, রেশনে ‘লাইনে’ দাঁড়াই, মৃত্যুর ‘মুখে’ দাঁড়াই, নিজের ‘পায়ে’ দাঁড়াই, যুদ্ধ ‘ক্ষেত্রে’ দাঁড়াইকিন্তু, সময়ের ‘ওপর’ দাঁড়াই। মুখ থেকে বেরিয়ে সে কথা সময়ের ওপরেই পড়ছে।’
—‘কোন্‌ সময়?’
—‘এ হল সেই সময় যাকে ভেজাতে শিখতে হয়, শৈশব থেকে। কেচে জল নিঙড়ে ছাদে মেলে রাখতে হয় ক্লীপ এঁটে। এবং মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতে হয় কতটা শুকোলো।’  

‘‘বজ্রাসন ও অন্যান্য তীর্থদর্শন করিয়া পণ্ডিত ক্ষিতিগর্ভ আদি বিংশতি জনের মণ্ডল লইয়া আচার্য্য অতিশা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ভারতসীমার নিকট এক ছোট বিহারে উপস্থিত হইলেন। দীপঙ্করের শিষ্য ডোম-তোন তাঁহার ‘গুরুগুণ ধর্ম্মাকর’ গ্রন্থে লিখিতেছেন—‘স্বামীর ভোট প্রস্থানের সময় ভারতে (বুদ্ধ) শাসন অস্তাচলগামী। ভারতের সীমার নিকট অতিশা দেখিলেন, তিনটি ছোট অনাথ কুক্কুরশাবক পথের পাশে পড়িয়া আছে। ষষ্টি বৎসরের বৃদ্ধ কি এক অনর্ব্বচনীয় ভাবের প্রেরণায় নিজ মাতৃভূমির অন্তিমচিহ্ন স্বরূপ এই তিনটি কুক্কুরশাবককে নিজ চীবরে উঠাইয়া লইলেন’।’’   
নিষিদ্ধ দেশে সওয়া বৎসর, উদ্যোগ পর্ব, পৃঃ ১৩১; রাহুল সাংকৃত্যায়ন    


জ্যাক দেরিদা
আগেই বলা হয়েছে, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, সময়ের মাঝখানে থাকা সেই গুপ্ত দরজা, যার ভেতর দিয়ে এক কাল থেকে আরেক কালে আসা-যাওয়া সম্ভব হয়; ফলতঃ, ইতিহাস বইয়ের তারিখ-সন লেখা ক্যালেন্ডারের ক্রম ধ’রে আমরা আসি না। বস্তুত, বোঝাই যাচ্ছে কোনও কিছুই এখানে স্থির, নিশ্চল ও প্রাক্‌প্রদত্ত নয়। বুদ্ধ, চণ্ডীদাস, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, কমলকুমার, ঋত্বিক, সন্দীপন, অরুণেশ, নবারুণ এমনকি স্বয়ং জাড্য ইতিহাস—সবাই ঢুকে পড়ছে এ-ওর স্লটে। ইট ইজ আ ফেস্টিভ্যাল। আ্যন্ড দ্য ফেস্টিভ্যাল মাস্ট বি আ পলিটিক্যাল অ্যাক্ট। অ্যান্ড দ্য অ্যাক্ট অফ পলিটিক্যাল রেভোলিউশন ইজ থিয়েট্রিক্যাল।   

     (চলবে)


My Blogger Tricks

0 comments:

Post a Comment