কবি মনীন্দ্র গুপ্ত এবং কবি দেবারতি মিত্রের পরিচয়পর্ব নিছক বাতুলতামাত্র। কবিতা যাদের কাছে জীবনের সমান্তরাল নয়, প্রেম নয়, তাদের প্রসঙ্গে এই
প্রতিবেদনে জন্ম, কর্ম ইতাদি প্রভৃতি তথ্যের কচকচি এবং বিয়ের বেনারসির মোড়কটা কতক্ষনে
পেরিয়ে হাতে পাওয়া যায়, তারই প্রতীক্ষা থাকে অবিরত। সুতরাং অতিসংক্ষেপে আমরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টাটুকুই করতে পারি বাংলাভাষার আশ্চর্য
এক কবিদম্পতির অসামান্য যৌথ যাপনের দিগন্ত টিকে ......
মনীন্দ্র গুপ্ত
কবি মনীন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৯৩০। তাঁর শৈশব কাটে
অভিবক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। স্কুলের শিক্ষা প্রাপ্ত হন আসামের শিলচর এবং
কলকাতায়। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ভারতীয় সেনায় যোগদান করেন এবং উত্তর
পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছুকাল কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে মেশিন ডিজাইনের
শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী তার কবিতা যাপন সাধকের তন্ময়তায়। তার আত্মজীবনী "অক্ষয়
মালবেরী"। অজস্র কাব্য ও গদ্য গ্রন্থের প্রণেতা কবি
মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতা বিষয়ক গদ্যের সংকলন
"চাঁদের ওপিঠে" জড় বস্তুকেও কবিতাময় করে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১০ এ তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা একাডেমী দ্বারা ভূষিত হন এই রাজ্যের তৎকালীন
সর্বোচ্চ সম্মান "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ তার "টুং টাং শব্দ
নৈঃশব্দ্য" এর জন্য। ২০১১তে "সাহিত্য একাডেমী" প্রাপ্ত তার কাব্য গ্রন্থটি
ছিল "বনে আজ কনচের্টো"। তাঁর অন্যান্য কাব্য গ্রন্থের মধ্যে
বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল .........
‘নীল পাথরের আকাশ’, ‘আমার রাত্রি’, ‘মৌপোকাদের গ্রাম’, ‘লাল স্কুলবাড়ি’, ‘ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ’, ‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’, ‘নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ’, ‘মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়’, ‘এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্রানস’, ‘নিরক্ষর আকবর’
আপনার কবিতা লেখার সূচনা সম্পর্কে
বলুন।- শিলীন্দ্র ৯৪ সংখ্যায় কমল
মুখোপাধ্যায়ের এমনই প্রশ্নের উত্তরে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন- “ একজন
দোয়েল কবে গান গাইতে শুরু করেছিল? একজন উদবেরাল
কবে সাঁতার কাটতে শুরু করল? একজন মৌমাছি কবে কেমন করে চাক
বাঁধতে শিখল?এসব প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে? মনে
পড়ে চেতনা জাগার পর থেকেই নির্সগ আমাকে দারুন মুগ্ধ করত। নির্সগের সৌন্দর্য আমি
অনুভব করতে পারতাম- মন কেমন করত- মন আঁকুবাঁকু করত। সেই পলায়মান সৌন্দর্যকে আমি
মন দিয়ে ধরে রাখতে চাইতাম। অপরিচিত অর্ধপরিচিত যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার
মুখ ও আকৃতি আমি বিস্ময়ের সঙ্গে নিরীক্ষন করতাম। তাদের ঐ বাইরের খোলস, নড়াচড়ার
ভঙ্গি দেখে দেখে ক্রমশ আভাস পেতাম তাদের
জীবনের, রহস্যের।
ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম, মৃত্যু, সময়, মহাকাশ
নিয়ে নানা দার্শনিক চিন্তা মাথায় ঢুকল। এই সময় আমার মনে হত, আমি
হয়ত চিত্রকর এবং ভাবুক। একসময় আর পাঁচটা ছেলের মতো লিবিডো আমার মধ্যে প্রবল হয়ে
উঠল। হতে পারে, তারই তাড়নায় আমার কবিতায় মনোনিবেশ। অন্তত আমার প্রথম বই ‘আমরা
তিনজন’ সেই কথাই বলে। তারপর একদিন লিবিডো আমাকে দংশন করল। বিষ
টেনে নেবার জন্য এই সময় কবিতাই
বিষপাথরের কাজ করেছিল। ক্রমে কবিতাই আমার পরম আশ্রয় হল।
ফিরে দেখা যাক আলোচক রমিত দে-র
মনোজ্ঞ পর্যবেক্ষণ কবি মনীন্দ্র গুপ্ত
প্রসঙ্গে "বাক" এর
পুরনো পাতা থেকে।
মনীন্দ্র গুপ্তের বহুমাত্রিক দ্বৈত
অদ্বৈততায় পৌঁছতে গেলে, তাঁর ন্যারেটিভস এর রাপচারগুলিকে স্পর্শ চিহ্নে গাঁথতে গেলে, বৃহত্তর বুননের, ডায়মেনশানের একটা শুরুর দিকে যাওয়া
যেতে পারে। কিন্তু বাংলা কবিতার অনুগত দশকীভাগে তার আয়োজনতো স্বেচ্ছানির্মিত! আঙ্গিক থেকে স্বরায়ন, ব্যক্তি প্রতিবিম্বে বহুস্বরিক
তাত্ত্বিকতায় তিনি যেন নিজেই এক গতিময় রেখা, এক রহস্যময় রং। দশকচিহ্নিতহীন কবিতার পিঠে চেপে শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, পিকিং মানুষের ফেলে দেওয়া ভাঙা
হাঁড়ি-সরার খেলাঘর গুছিয়ে ত্রিমাত্রিক চেতনায় মেতেছে তাঁর অনতিক্রম স্বতন্ত্র। প্রকৃত অর্থে তিনি এক পরিব্রাজক। যাত্রার মধ্যে সীমার মধ্যে
নির্বাচনগুলির মধ্যে শতশরতের আয়ু নেওয়া অক্ষর পুরুষ। তাঁকে কিভাবে ভাবব! চল্লিশের কবি? পঞ্চাশের কবি? ষাটের কবি? নাকি ২০১১ তেও বর্ষীয়ান কবির নবতম
সংযোজন ‘নিরক্ষর আকবরে’ তার যোজন যোজন বীতস্বপ্ন এক অনাস্বাদিত চলাচলের কথা, এক সাহজিক অভিযাত্রার কথাই চিনিয়ে যায় কথনবয়নের মনীন্দ্র কে!-“দুঃখ বা শোকের মত ভারী কিছু না এই মসলিন/ আমার ভাঙা গাল, ছেতরে যাওয়া ঠোঁটকে/ ঢেকে রেখেছে সাদা উড়ন্ত দাড়িগোঁফ/ সেও যেন
মসলিন/.......এবার যেন একটু আগেভাগেই/শীতের দেশ থেকে বক সারস আর হাঁসেরা এসে নামছে
বিলে/ আমাদের, আশি বছরের বৃদ্ধদের, প্রেম ক্ষুধা শোক ও ভ্রান্তির পাশে/ পক্ষীজীবনের কয়েকটা রাত কাটাবার জন্য...(
বুড়োদের সঙ্গে পাখিদের)”। তাঁর কোলাহলহীন অবিশ্রাম স্থিতিবিন্যাসের পাশে, পাহাড়প্রমান মনঃসংকলনের পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হয় অসংখ্য সাদা ফুল, অসংখ্য ভিজ়ে মাটি, অনন্ত ফেরিওয়ালার ক্ষীন গলিপথ ধরে ফেরা
আর ফিরে দেখার এক অসমীকরন নিয়ে চিরসত্যের দিকে চলেছেন, চলেছেন নির্বিকার সম্ভারের দিকে। খড়কুটো-মরা-পাতা অতীন্দ্রীয় ঋতুচক্রের ভেতর
লুকিয়ে রেখেছেন নিজের পথ নিজের অনুভাবিত ভাঁটফুলগুলি। উতরোল সমুদ্র জীবনে গোলাপি
পায়ের পাতা হাঁসের মতই বট পাকুড়ের ব্যাপারী হয়ে কোথাও শূন্য থেকে লাফিয়ে
নেমেছেন শ্রমনে আবার কখনও শূন্যের উন্মুক্তিতেই ভাঙা জানলার ছবি আঁকতে আঁকতে দৃশ্য
সাদৃশ্যে কবিতামন্থনে শেকড় বাকড় চারিয়ে বিস্ময় থেকে বিযুক্তি থেকে একীভূত
পরিনামে স্রষ্টাকে পেরিয়ে যাচ্ছে তার অলখ অনুগত যাত্রা।
পথনির্দেশিকায় তিনি চেয়েছেন পূর্ননির্মান। অকলুষ সমগ্রতা।
নিজের কাছে নিজের সম্বোধনের কাছে নিজের জন্মান্তরের কাছে নাছোড়বান্দা এক পথিকের
পথপ্রাননা। যেন স্মৃতির একান্ত থেকে সংসারী
সারসংকলনের উপাদানগুলি থেকে, ঢেঁকিশাক গাবগাছ আর বেতফলের
প্রাগৌতিহাসিক স্থাপত্যগুলি থেকে বর্ষীয়ান কবি শব্দের বিমোহন কুড়িয়ে পৃথিবীর
ভাষা কুড়িয়ে উত্তরাধিকার দান করেছেন পরম্পরার পাঠককে। সব নিয়ে মনীন্দ্র গুপ্ত। শিউলি ফুলের
ফুটো দিয়ে বেরোলেই পাওয়া যাবে সাদা মেঘের দেশ আর স্বর্নচাঁপার ফুটো দিয়ে
বেরোলেই মুনশীবাড়ি। আবার জ্যোৎস্নায় ফোটা হাস্নুহানা ফুলের সুক্ষ পথটূকু পেরোলেই
ঝাড়লন্ঠন নিবে আসা এক চাঁদনী জলসার দেশ। হাটখোলা পৃথিবীর দ্বন্ধ, নিরাময়, খন্ড খন্ড ধ্যাননিবিড় ডায়ভারসিটির
মধ্যেই যেন মনীন্দ্র গুপ্তর কল্পকলোনী। তার কবিতাকে, তার অনির্দেশ চিত্তবৃত্তিকে জানতে হলে আমাদের ফিরে আসতে হবে এই নৈসর্গিক
গুটিপোকাদের কাছে, আঁকড়ে ধরতে হবে মাটি, পাহাড়ের পরিচর্যাকে। প্রাকৃতিক
বিশুদ্ধতার তুবড়ে টোল খেয়ে যাওয়া জীবনমিতির মাঝেই পরবাসী কুড়ানীর মতো
মধ্যবর্তী বৈভবগুলোকে সামিল করে নিতে হবে তাদেরই গন্ধসলিলে। এই স্পিরিচ্যুয়াল
রিনিউশনেই যে বৌদ্ধ শ্রমনের মত তিনখানা কাপড়, একটি ভিক্ষাপাত্র, একটি ছোটো কুড়ুল, একটি ছুঁচ, একটি কটিবন্ধ ও একটুকরো জল ছাঁকার ন্যাকড়া’ নিয়ে
কবিতার সংখ্যাতত্ত্বের থেকে মনীন্দ্র গুপ্ত পাড়ি দিচ্ছেন সহজিয়ার দিকে.............
এবার আমরা পাঠ করি
কবি মণীন্দ্র গুপ্ত-র অপার রত্নরাজির নয়টি কবিতাকে।
গল্পগুলো
মণিকর্ণিকার দেশে বিকেল ফুরোয় না। —শুয়ে থাকে
শান্ত অনন্তনাগের মতো অপরাহ্ণ ভরে।
নেশাড়ু বুড়োর কাঁধে আচাভুয়া পাখি নেমে
বলে :
গপ্পো বলো—
জনহীন গোল চাতালের পিছে
পাহাড়ের মতো শূন্য উঁচুতে উঠেছে,
শূন্য সামনে নেমেছে খাদ হয়ে।
নেশার বুদবুদ— বিড়বিড় ভাষায় লহরী শোনা যায়— উদ্ভট শ্লোকের
ভাঙা সুর :
উত্তরকুরুর বন্র চামরী গরুরা নীল ঘাস
থেকে
আকাশে লাফিয়ে ওঠে—
বৈকাল হ্রদের জলে ছায়া পড়ে নোমাডদলের।
একটা গল্প, শেয়ালের মতো গর্ত থেকে বের করতেই
গ্রামসুদ্ধ তেড়ে এলো—মার, মার! ধূর্ত বদমাশ, হাড়িচোর!
আহীর গ্রামের ভরা যুবতীরা ঘড়া ভরে দুধ
নিয়ে মিশে যাচ্ছে
দিগন্ত রেখায়।
নিকটে গাছের গম্ভীর ভাঙা দালানের ঘরে ঘন
ছায়া—
একজন রাহী ঐখানে ফিরে এল সন্ধ্যাবেলা—রাত্রে এক মুশকিলয়াসান
তার আধখানা মুখে আলো ফেলে।
গোল চাতালের নিচে দূর খাদে, দুইজন চোর
হিমরাত্রে আগুনের কুঞ্জ জ্বালিয়েছে।
চাদনী রাতে স্কারটারিস পাহাড়ের ছায়া পড়ল
স্নেফেলের অনন্ত সাদায়।
দূর থেকে উদ্ভট শ্লোকের সুর শোনা যায়
ঘুমের মতন।
গল্পগুলো পাখির ডিমের মতো ভাঙে…
দেখা যায় না
এপার ওপার
কোথাও আরম্ভ নেই, শেষ নেই। তবু মানুষের দেশে ঢেউ
মানুষেরা কুলোর বাতাস নাড়িয়ে নাড়িয়ে
তোলে। ফেউ
না ডাকলে রাতের চৌকিদার
রাতের স্রোতের মধ্যে মিশে যেতে পারে— এই ভয়ে
মানুষেরা বিকেলের নিস্তরঙ্গ আলোয় ভানতে
ভানতে ধান,
বাঁশঝাড়ে সূর্য পাটে বসলেও, ঢেঁকিশালে পা ছড়িয়ে গায়
শিবের বিয়ের গান।
হায়! তুচ্ছ মাছিটিও সোনার মতন সনাতন মলে ও কমলে।
শুধু আমাদেরই,
শুধু আমাদেরই কৃতকর্ম নড়েচড়ে
প্রতিবেশীদের নষ্ট জিভে।
ধেয়ে আসে
কুলোর বাতাস!
অতশত কে জানত!— তাড়া করতেই আমি আপাদমস্তক ভীরু
পালিয়ে পালিয়ে মগডালে…
তবু মাটির নিচের গাঢ় মাটি সরিয়ে মাটির
অশরীরী
বলেছিলঃ
এই পৃথিবীতে যার আজ কোন চিহ্ন নেই— যে ছিল অনেকদিন আগে
পোড়া ভিটের পোতায় তার দড়ির মতন শিরা, মরা চুল, আংটির কাঁচ
বিঁধে আছেঃ লোকাপবাদের স্মৃতি।
গাছের গুঁড়ির ফাঁকে বনময় সায়ং হিমের নিচু
স্রোত
ঘুমন্ত নাচুনী যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে
আঁকাবাঁকা—
সাবধান!
চেঁচিয়ে ওঠার আগে কেউ, আমি উড়ে গিয়েছি সেখানে…
বন থেকে শীতহিম পোকার ঝাঁকের মতো ওঠে
জগৎকুয়াশা আরো ঘন হয়
দেখা যায় না এপার ওপার
বনবাসী আত্না
কোনো বনবাসী আত্না সেদিন রাত্তিরে
নেমেছিলো আমাদের ছাদে।
আমি স্থির হয়ে থাকতে পারি নি। ঝুঁকে
পড়েছিল এক গভীর জঙ্গল—
গাঢ়মূর্তি গাছের কল্লোল-ছায়া
ফিসফাস করছিল কবাটে গরাদে
অপদেবতার মতো। তৃষ্ণার্ত ঝাঁজালো বায়ু
বয়ে গিয়েছিল
ঈশানে নৈঋতে।
জন্মর্থী প্রাণের দল সদ্য নরকের থেকে এসে
সেইখানে
আলোর আড়ালে যেন ভূমি পেয়েছিলো জন্মবার।
আমি স্থির থাকতে পারি নি— আসক্তির মতো এক অমঙ্গল
আমারও গহন টুঁটি টিপে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো
ছাদে।
সেই বনবাসী আত্না প্রকৃতিত সাংঘাতিক
সম্রাটের মতো
রাজাজ্ঞা শুনিয়েছিল গমগম নিঃশব্দ আকাশে।
কোনো মেসোজাইক ডাইনোসর অদ্ভুত আওয়াজ ক’রে
লালাসিক্ত ফাটা জিভে চেটে নিয়েছিল আমাদের
কিম্ভুত পোশাক।
আমি শঙ্কা ও সভ্যতা ভুলে, সেই ঘন গভীর আরাবে ভরে গিয়ে
যা-কিছু চিন্ময় ছিল সব
দিয়ে— মৃন্ময় প্রাণের অন্ধ মূলে
সাষ্টাঙ্গ হলাম।
মহিম্ন স্তোত্র
বাউলের মতো আমি ভিতরে জ্বালাব বাতি : এই
অলীক
ঘুরিয়ে মেরেছে বহুদিন। বহুদিন এই জন্যে
নির্বাপিত থেকেছি আঁধার
ঐ টিমটিমে নিজস্ব বাতির জন্য এত লোভ!—এই এক অভিমান, মায়া।
তবু ভাগ্য, ঈশ্বর আমাকে ফিরিয়েছেন ঠিক পথে—রোদ্দুরে, কাদায়, জলধারে,
মোষের মতন পাঁকে, সাপের মতন পদ্মবনে, সন্ন্যাসী-বাঁদর-অভিমানে।
ভাগ্যিস জ্বলে নি আলো, তাই এখন বিশালতা ছুঁতে পারি :
নীলের গহন অভ্যন্তরে ফুটে ওঠে সুদূর
মন্দির। এখন মেঘের দেশে
বেলা যায়। ভেসে যায় স্নেহে দশদিকে তোমার
হাসির মুখখানি।
আমি বিকেলবেলার সূর্যে মুখ রেখে, অবাস্তব এখন মিলিয়ে যেতে পারি,
যাই নীরব রোদ্দুরে।
অশ্রু
পাখির মরণ যখন ঘনিয়ে আসে
তখন তার ডাকের মধ্যেও ব্যথা ফুটে ওঠে।
মাঠের কাকতড়ুয়ারাও তা বোঝে, সারা রাত তাদের হাঁড়িমাথায়
শিশির পড়ে পড়ে ভোরবেলায় চোখ ভিজে উঠেছে।
হেমন্তের ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে তারা দেখে
– কৃষক আসছে,
গোরু আসছে। ওদের চুনে আঁকা চোখ কি শেষ
পর্যন্ত
আমার জ্যান্ত চোখের চেয়েও অনুভূতিপ্রবণ
হল!
আমার কেউ আসেও না, যায়ও না।
রাত্রে গোরের থেকে যারা ওঠে তাদের কান্না
কে শুনেছে!
যাবার আগে, আমার শেষ সান্ধ্যভোজের শক্ত পাঁউরুটিটুকু
অন্তত যাতে ভেজে,
আমি সেইটুকু চোখের জলের অপেক্ষায় আছি।
ছাই
ছেলেবেলায়
পায়রার গলায় ছুরি বসিয়ে
লিচুগাছের ডাল ভেঙে
দুই কাঁদি তালশাঁস খেয়ে
বাগান লণ্ডভণ্ড আর পুকুরের জল ঘোলা করে
দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরতাম
তখন ঠাকুমাবুড়ি মাকে শাসাত :
খবরদার বউমা, ওকে আজ ভাত দেবে না
উনুনের ছাই বেড়ে দেবে।
ঠাকুমা কবে মরে গেছে। আমিও মরমর।
কিন্তু এতকাল ধরে আমরা বাগান লণ্ডভণ্ড
করেছি
শয়তানের পিছনে কাঠি দিয়েছি।
এখন মাটির নিচে জল পাঁচ মিটার নেমে গেছে।
মেঘ আসে কিন্তু লাফায় না, গর্জায় না, মরা মাছের মতো নীরবে ভেসে যায়।
বেশি টানাহ্যাঁচড়া করলে মাটি থেকে জলের
বদলে আর্সেনিক ওঠে।
গাছের শিকড় নুন মাখানো জোঁকের মতো সিটিয়ে
গেছে –
নিচে যেতে পারে না। পুত্রবধূ আর
নাতবউয়েরা
পাথরের ফাটলবাসী গিরগিটিদের মতো
ধুলোমাখা।
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
কতদিন ঘরে এক দানা চাল নেই –
বউমা, ওদের ভাতের বদলে
ছাই বেড়ে দাও,
উনুন থেকে গরম ছাই তুলে দাও।
বাড়ি
আমি পারি না। কিন্তু তোমরা প্রত্যেকটি
পরিবার বাড়ি তৈরি করো-
আনন্দময় বাড়ী।
আমি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান
করে দেব,
নিজে দেখাশোনা করে বানিয়ে দেব।
গোনাগুনতি খোলা সিঁড়ি ছাদে উঠে গেছে
এমনভাবে যেন শিশুরা
মনে করবে তারা আকাশে উঠছে। বাজপাখি দুপুর-মৌতাতে
পাহাড়চূড়া ভেবে জলের ট্যাংকে এসে বসবে।
আবার ঝড়ের মধ্যে
মনে হবে। কংক্রিটের এক বেঁটে পালোয়ান
চার হাত-পায়ে
উবু হয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে, প্রতিদ্বন্ধী কিছুতেই তাকে চিত
করতে পারছে না।
ফার্নিচারও আমি ডিজাইন করে দেব, আপহোলস্টারি পছন্দ করে
দেব।
ধূসর-সবুজ জলের মধ্যে
তন্বঙ্গী সরলপুঁটি যেমন ঝিকমিক করে
তেমনি, ছায়াছন্ন ঘরে তোমাদের কিশোরী মেয়েটিকে মাঝে মাঝে
দেখা যায়- কাজ করছে, বই পড়ছে। দিনশেষে বাড়ি ফিরে
নিজের কৌচটিতে বসে বলিষ্ঠ রুইমাছের মতো
তুমি শান্তি
পেতে পেতে দেখবে, মৃদু আলোয় তোমার চারপাশে
জলজ কুসুমেরা দুলছে।
আমার নিজের বাড়ি কেমন হবে সে কথা ভাববার
সময়
আজ পেরিয়ে গেছে।
গড়িয়ার মোড়ে
শহরতলি শেষ হয়ে যেখানে গড়িয়াগ্রামের
শুরু
সেখানে বহুকালের একটি বেশ্যাপাড়া আছে ।
বেশ্যাদের সঙ্গে গলির একটা প্রাচীন
সম্পর্ক,
অতএব সেই পাড়ার দুটো গলির মুখে
দিনরাত কয়েকটা মোড়া পড়ে থাকে,
সেইখানে ঐ মেয়েরা এসে বসে, অপেক্ষা করে।
গড়িয়াগ্রামে কয়েকটা অতি পুরনো ছোট
পুকুর আছে।
চারপাশ থেকে গাছপালা ঝুঁকে পড়েছে,
অ্যানোডাইজড ধাতুপাতের মতো ধূসর পাঁশুটে
জল-
অদ্ভুত সেই পুকুরগুলো ঘোর তামসিকতায়
আচ্ছন্ন ।
ঐ পুকুরগুলির ঘাটে যেমন চ্যাং বা
চ্যাপটামুখ গজাল মাছেরা এসে
খাদ্যের খোঁজে মুখ তোলে, মেয়েগুলো ঠিক তেমনি ঐ গলির মুখে
তাদের ঘোলাটে শরীর নিয়ে চারপাঁচজন করে
আসে,
তাদের চ্যাং গজালের মতো মুখগুলো তুলে
খাবার খোঁজে।
ঘুঘু
শীতের দিন। আশি বছরের পুরনো ফুসফুস
যেন উমা কর্মকারের তালি দেওয়া হাপর-
নিঃশ্বাস নিই আর ঘুরুর ঘুরুর শব্দ হয়
দুটো ঘুঘু এসে পোড়ো ভিটেয় বসেছে যেন।
নিকোটিনে ঘাস চোরকাঁটা পিঙ্গল-
তাদের উপর রোদ্দুর আর ভাঙা উনুনের ছায়া
।
আমি ঘুরুর ঘুরুর শব্দ শুনি
আর খুব নজর করে দেখি
বুকের মধ্যে ঘুঘু নেমেছে।
ঘু ঘু ঘু ঘু – গাছ নিঃশ্বাস ফেলে,
ছায়া পাখির খোলা খাঁচার নকশা, তাল গাছের ছাপ
আর ভাঙা জানলার ছবি আঁকতে আঁকতে
ডান দিকে সরে।
শেষজীবন বড় মিষ্টি।
পোড়ো বাড়িতে ঘুঘু নামে,
হেঁটে বেড়ায়
ডাকে।
"বাক ১০০" এর জন্যে অপরিসীম
মমত্বে অসুস্থ শরীরকে উপেক্ষা করে লিখে দেওয়া মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতাটি রইল
পাঠক সমীপে "বাক্" পত্রিকার পক্ষ থেকে আমাদের বিনম্র নিবেদনরূপে।
ভদ্রা
আর হাওয়া
ভদ্রা তোমার দিদির নাম
ভদ্রা কি কোন তারার নাম?
ভাদ্র মাস তার নামটি পেল কোথায়;
মাটি থেকে আধ মাইল ওপরে তাল পেকেছে,
একা একা হাওয়া বইছে শোঁ শোঁ ----
হাওয়া হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পাকা তালের বোঁটা
আলগা করছে।
তালের সুগন্ধ নিয়ে খেলতে খেলতে হাওয়া
আধ মাইল ওপর থেকে লক্ষ্য করছে তোমার দিদিকে
মাঠের মধ্যে।
সড়াৎ করে নেমে এসে হাওয়া দিদির কানের পেছনে
চূর্ণ কুন্তলে ফুঁ দিল। জিব
বুলিয়ে
কাতুকুতু দিল। ধনেখালি
শাড়ির মধ্যে ঢুকে
শরীরের উঁচু - নীচু জায়গায় হাওয়া নিজেকে
উঁচু - নীচু করল।
ভদ্রা দিদি অঞ্জনা বাঁদরীর মত মাঠের মধ্যে
সচকিত, একাকী।
দেবারতি মিত্র
১৯৪৬ এ জন্ম পোস্ট কলোনিয়াল ভারতীয় মানসে প্রচলিত প্রান্তিক নারীবাদীত্বের সংজ্ঞা
কে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো কবি দেবারতি মিত্র। ১৯৭৪ এ প্রকাশিত হয় তাঁর
প্রথম কাব্যগ্রন্থ "অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজে"। যোগমায়া দেবী কলেজ এবং
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এঈ কৃতী ছাত্রীটি বাংলা কবিতায় উত্তর আধুনিক এমন এক গঠন
আর নির্মাণ শৈলীর জন্মদাত্রী যা বিশ্ব ব্যাপী উচ্চ প্রশংসিত। তার রচনাকে একাধারে যেমন আলোকিত করে
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ তেমনই এলীয়োট ও কিটস। শাক্ত সচেতনতার দুর্মর গতিও আমরা
তার কাব্যের উদ্ভাসে পাই। তিনি ১৯৯৫ তে লাভ করেছেন "আনন্দ
পুরস্কার"। তার কবিতা গুলির ইংরাজি অনুবাদ করেছেন ক্যারোলিন রাইট। তার
প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা নয়টি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলির নাম হল ...
"ভূতেরা ও খুকী", "যুবকের স্নান", "আমার পুতুল"
ইত্যাদি।
সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে কবি দেবারতি মিত্র জানিয়েছেন
দেশ-কাল, প্রতিবেশ, পরিবেশ, বাদ দিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব নয় তাঁর
পক্ষে। নির্জন দ্বীপে বসে কবিতা চর্চা করতে তিনি চান না। কবিতা নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে কবিতা নিয়ে একা একা ভাবতেই তিনি বেশি ভালবাসেন
বেশী। কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি দাবী করেন যে
তিনি দেখেছেন কবিতাকে "না পারছি ঠিকমতো বুঝতে, না পারছি বোঝাতে, কবিতার ভাব ও মর্ম কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে"। তিনি অন্য কবির কবিতা প্রচুর পড়ে তা থেকে সবটুকু রস নিংড়ে
নিতে চান। তাঁর ভাষায় "যেসব ধাত্রী অন্যের সন্তান প্রতিপালন করেন, নিজের ছেলেমেয়ের প্রতি কি তাদের মায়া ও টান একটু কমে যায়?"
কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন
"আমাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত সংসারের কাজকর্ম করতে হয়, ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে যেতে হয়, সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়, সেগুলো আমার খারাপও লাগে না। কিন্তু কী করে জানি না, তারই মধ্যে চলে একটা স্পন্দন কবিতার আবছা বিচ্ছুরণ, আড়মোড়া ভাঙা, নানারকম ছেড়াখোঁড়া হাসি ও বেদনা। আবার
অনেকসময় বাজার করতে গিয়ে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েও পেয়ে যাই কবিতার
বীজ। কখনও কখনও তা থেকে গাছ জন্মায়, আর কখনও তা
বৃষ্টিজলে, অশ্রুতে ধুয়ে যায়, কোনও চিহ্নই
থাকে না। তবু বেশ লাগে। অনেকদিন কবিতা লিখতে না পারলে একটু হতাশ হয়ে পড়ি তো
বটেই............ঘটনাচক্রে ছেলেবেলায় অনেক কবিতা এবং নানারকম বাংলা গান শুনেছি।
তার কিছুদিন পরে কবিতা পড়তে পড়তে নিজেরও কবিতা লেখবার ইচ্ছে হল, বড়দের দেখে যেমন একদিন শাড়ি পরার সাধ হয়েছিল............কবিতা এবং সবরকম
শিল্পই সম্ভব-অসম্ভব, বাস্তব-অবাস্তব, উচিত-অনুচিতের বাইরে হয়ে ওঠাই তার একমাত্র শর্ত। কবিতা যদি উতরে যায় তবেই তা
সত্যে পৌঁছতে পারে। আমি সত্য বা মিথ্যে কোনওটাই লেখবার চেষ্টা করি না। শুধু এক
অনর্গল চিরনতুন চিরপ্রাচীন প্রবাহকে কবিতায় ধরতে চাই.....নিজেকে মেয়ে-লেখক হিসেবে
আমি নিজেকে আলাদা করে ভাবি না। আমি নারীত্বের পক্ষে, কিন্তু মেয়েলিপনার বিপক্ষে "
আসুন, পাঠ করি এবার দেবারতি
মিত্র-র প্রকাশিত নয়টি কবিতা ...
নীল আরো কত
এখন আমাকে ডেকো না,
এখন আমাকে কিছু বলতে বোল না।
এবার সন্ধ্যা আমাকে ভর করবে,
এরপর আমাকে সন্ধ্যায় পাবে।
অপরাজিতা ফুল হালকা হ’তে হ’তে
কুমারীর নিঃসঙ্গতা,
তারপর উলুঘাসের বনে গোপনচারী সাপ,
নীল আরো কত যে!
কতরকম জীবন---
নীলবর্ণ ওঙ্কারের শব্দ সমস্ত প্রান্তর জুড়ে।
তোমার চোখের মণি যেন
স্বপ্নে, প্রেমে, কান্নায়
মজে যাচ্ছে।
কথা দিয়ে যা গড়ে তুলেছি, তা মুছে যাক,
ছায়ার বর্ষণে ডুবন্ত দ্বীপের মতো নিশাকাল
আকাশ, সমুদ্র যেন বা আমার ভুরুর
মধ্যিখানে ।।
.
মা থাকো
কলঘরে ভিজে মেঝে - বসে বসে চুল ছড়িয়ে
কাঁদি -
তাও যদি ছিঁড়ে যায় আমার একটিমাত্র রক্তের
বন্ধন !
মা, তুমি
দাঁড়িপাল্লার যেদিকে রয়েছ, তার অন্য দিকে ব্রহ্মাণ্ড
সম্পূর্ণ ওজনশূন্য, ফাঁকা।
সমুদ্র-ঝিনুকে জন্ম, পড়ে আছি শুয়োরের পায়ের কাদায়।
জন্ম ও কর্মের হাত পাল্লা কষে -
নীল বাষ্পে সব রক্তকোষ ফেটে যায়
আমি যেন আকাশের বহুতলা উঠে গেছি
আলোয় যেন চির আকস্মিক।
রাক্ষস খোক্কস নেই এই দেশে,
রাক্ষসের ছেলে এসে বলবে না - দেখা
আলজিভ।
পরি চাঁদ টি দিয়েছে, আহ্লাদ-কাজল দেবে মেঘ,
মা-গান শুনতে শুনতে
তারাদের মধ্যিখানে তারা হয়ে কাঁপি।
মা থাকো মা থাকো মা থাকো
পরলোক কোনদিকে - সে জগতে
হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে একা অন্ধকারে হেঁটে
তোমাকে, যদি না খুঁজে পাই ।
লালটিপ সাদাটিপ
কচুর পাতায় আঁকা লালটিপ,সাদাটিপ
ব্যাঙের বাসাটি তার কাছে।
শালিখের বউ বলছে কিচমিচ —
এ সংসার থেকে মণ তুলে নাও,
পোকাটোকা পড়ে থাক, চল,
চল না দুজনে আমরা ওড়ি।
ছেলেবেলাকার সেই বাগানে কষ্টও ছিল,
ব্লেড দিয়ে নিজের আঙুল কেটে
কাঁঠাল পাতায় লাল দাগ।
কোন কিশোরের কাছে চির অঙ্গীকার,
ভয়মেশা কতদূর স্বপ্নরেখা, ধবধবে রোদ্দুর
সাদা ময়ূরের পাখা যেন ভুতগ্রস্থ,
আকাশে তখন অভিসার সূর্যের একাকী।
কচুর পাতায় আঁকা
সাদা টিপ, লালটিপ,
ছেলেবেলা এখনো
কি বাকি?
নিশানা চেয়েছি
আপনার, তোমার, তোর, আমার চারদিকে
পাকিয়ে
উঠছে ধোয়া-
প্লাস্টিক
জ্বালানো হচ্ছে নাকি পাতা পোড়াচ্ছে লোকেরা?
পাতা
কই?
এখানে
তো গাছ নেই, কেবল গাছের স্মৃতি।
তবে
কি ভিতর থেকে আমাদের দীর্ঘশ্বাস
ব্যথিত, ধূসর আকাশের দিকে যাচ্ছে,
বাতাসকে
মুখে মারছে আলগা থাপ্পড়।
কি
হয়েছে, কেউ কি রয়েছে পাশে
ঘাসের
সবুজ বউ, সমুদ্র দোলানো বৃষ্টিঝড়,
যে
উড়িয়ে নেবে কালি, অশ্রু, পাপ, নির্যাতন?
বাড়ির
গম্বুজে নীল কবুতর যেমন আকাশ দেখে,
বোঝে
মাপ, জানে নির্মলতা কতটুকু আছে আজও।
মানুষের
দিশেহারা শহুরে বিকেলে
তবে
কে দেখাবে পথ।
পৃথিবী
ও জীবনকে এখনও বলছি ডেকে,
এই
ধোঁয়া, এই আবিলতা তোমার অন্তরে নেই,
তুমি
যাকে চাও তাকে
পাবার
নিশানা বলে দাও।
পদাবলি
কোথায় সূর্যাস্ত
- দেবারতি মিত্র
দুঃখের বিনুনি খুলে বাঁধের জলের ধারে
বসে আছে
সূর্যাস্ত,
তাকে দেখিনি আজ
কতকাল৷
এখানে দক্ষিণ, পুব, উত্তর খোলা,
পশ্চিম দিকে
শুধু বাড়ির পর বাড়ি৷
বিকেল কি সোনার
কড়ায় উথলে ওঠা
এক রঙ, দু রঙ, সাত রঙের দুধ?
গোধূলি কি
রাজপুতানি মেয়ের
বৃষ্টিতে ভেজা
হাঁটু ছাড়ানো রঙচঙে ঘাঘরা?
তুমি আমার
বন্ধুর বন্ধু,
তোমার ঘরে গেলে
একমাত্র সূর্যাস্ত দেখা যায়
কিন্তু একটু দূর
থেকে বুঝি
ওখানে ছায়া, ছায়ার পর ছায়াক্ট
আরো মন খারাপ
হবে, ভয় হয়৷
তোমাকে জাগিয়ে
দেব, তোমার ক্ষতি করে দেব
ভেবে ব্যথা পাই৷
দুঃখের বিনুনি
খুলে বাঁধের জলের ধারে
সূর্যাস্ত যে আজ
কত যুগ৷
আমি পুব দিকে
প্রতিফলিত তাকে দেখে
দীর্ঘশ্বাস ফেলি, করুণ গান গাই৷
ব্যর্থতা একটি
মৌচাক
ব্যর্থতা একটি
মৌচাক ।
আমি সেখানে নানা প্রায়শ্চিত্ত থেকে এনে
অশ্রু ভরি ।
ভিজে বিদ্যুতের মতো তার ভিতরটা,
বাইরে মৃত করবীর বন।
এরকম যদি না হতো তবে
গ্রীষ্মে পানাপুকুরের কঙ্কালের সঙ্গে
মেলাতে পারতাম না আমার স্মৃতি,
বর্ষাকালের জলস্রোতেই যথেষ্ট হত
আমার নৌকাবিলাস,
শীতকালে মাটির রথ হতো পৃথিবী,
আর শেষ ঋতুতে আমলকি ফলের অভ্যন্তরই
হত বিজ্ঞান।
যা নিয়ে কৌতুক
আমার সর্বস্ব ছুঁড়ে ফেলে দিই খোলা মাঠে
ওদের টিনের চালে, পশুর হৃদয়ে।
সেখানে জন্মায় রোদ, জ্যোৎস্না, অশ্রুর
কল্পনা,
তারা সান্দ্র গান করে, ভয়
দেখায়,
অপূর্বতা আনে।
মায়ের স্মৃতির রুক্ষ নিদারুণ শোক,
মৌচাকের ভরা মধু তাঁর স্নেহ কাঁপে।
আমাকে ডেকো না, বলে কাঠঠোকরা পাখি।
প্রজাপতি উড়ে যায় ফুল ফেলে দূর থেকে দূরে।
আমার থাকে না কিছু,
তিলে তিলে সব চলে যায়।
শুধু সন্ধ্যা-অরুণের অস্তরাঙা সজীব বেদনা
বয়ে আসে লোকালয়ে, দেশকালে,
ব্যর্থ কবিতায়।
লুকোনো জানলা
লুকোনো জানলা
ঐ সাদা বাড়িটার জানলার কাচ রোদ পড়ে
অশ্রুর মতন অল্প চকচক করছে বিকেলে।
আমার দুঃখ আমি বলি না কারোকে,
আমার সুখও আমি বলি না কারোকে।
ছেলেবেলাকার ঢিমে উনুনে বসানো দুধ ঘন
হচ্ছে
এমন আলগা রঙ মেঘেদের।
না, অত বাস্তব নয়,
ফেলে আসা স্বপ্ন, হাসি, দীর্ঘশ্বাস, ভয়।
তোমারও কি কথা নেই, আপনার নেই?
ঐ যে মহিলা চুপিসাড়ে চলে গেল রাস্তার
দিকে,
ও কাকে দেখতে চায়, কার মুখে খোঁজে
কিশোরবেলার সেই লজ্জা, ব্রণ, বিদ্রোহের দাগ-
আজ হাস্যকর তবু তীব্র গোপনীয়।
আর বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাদে উঠে যেন
কয়েকটি ফুলগাছ ঠিকঠাক করে,
এটা একবার দেখে, ওটাকে সরায়।
হাতড়ায় মণিরত্ন,
কী যে এত ঢাকে, একমাত্র সন্তানের দোষ
কিংবা নিজের সন্তাপ।
আমার দুঃখ আমি বলব না,
আমার সুখও আমি বলব না।
আপনি কি বলেন, তুমি বল?
"বাক্ ১০০" এর জন্যে হাজার ব্যস্ততা অতিক্রম করে দেবারতি মিত্র
লিখে দিলেন এই কবিতাটি। এ আমাদের পরম পাওয়া। আমরা ভাগ করে নিলাম আমাদের উৎসুক পাঠকমহলের
সঙ্গে।
বর্ষার
বিকেল
আকাশের বড় বড়
চোখের পাতায়
যেন জল লেগে
আছে,
যদি পারতো এক
পশলা কেঁদে নিত,
কিন্তু নীল
পায়রা তিনটের জন্যে কিছুতে হচ্ছে না।
গোলাঘরে
ছাদের উপরে এসে বসে,
পাখা নেড়ে নেড়ে
তুড়িতে উড়িয়ে দেয় যত কান্না।
দাঁত ছিরকুটে
পড়ে আছে পৃথিবীর গাছপালা, ঘরকন্না,
জীবজন্তু, তাবৎ মানুষ।
কোথাও আনন্দ
নেই, স্বস্তি নেই,
ন্যায় অন্যায়
নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
হঠাৎ চকিতে
হাসি,
আকাশ বুঝল
কালো সবুজ হলুদ নয়,
সোনালিই সব
রঙের সার।
খাপচা নীলাভ
ম্লান জিনসের সঙ্গে তাই
সোনারঙ
রোদ্দুর উজ্জ্বল টপ
সাত তাড়াতাড়ি
গায়ে পরে নিলো
বর্ষার
বিকেলবেলা আজ।
দুই আত্মা , দুই দেহের মিলন নব কোন আলেখ্য নয়,
কিন্তু দুই কবি মানসের সমগ্র জীবন ব্যপী একাশ্রয়ে কবিতার সাধনা
বড় বিরল এক দৃষ্টান্ত। ব্যস্ত মহানগরীর নির্জন কোণটিতে সাধকসম একাগ্রতায় এই দম্পতির নিরলস পথ চলা। তাঁদের সংসারটি প্রকৃতই তপোবন এক, যেখানে শয্যাও স্তূপ
আকারে অজস্র বইয়ের অধিকারে। প্রার্থনা
করি তাঁদের নীরোগ দীর্ঘ আয়ু আর অমলিন সৃষ্টি সুখের দ্যোতনার ...তাদের আশীর্বাদের
শুভ আলো পাথেয় হোক নবীন ও তরুণের কাব্য বিকাশে।
(সোনালী চক্রবর্তী, বিভাগীয় সম্পাদক)
এই অল্প ছোঁয়াতে অনেক পেলাম। এই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা চলুক...
ReplyDeleteKhub valo laglo pore. Kintu onar jonmo 1930 e noy 1924e.
ReplyDeleteখুব খুব ভালো ❤️
ReplyDelete